সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের এক জটিল ভূখণ্ড, যেখানে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় দুই পরাশক্তি ইসরায়েল ও তুরস্ক। ইসরায়েল যেখানে নিজেদের সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, তুরস্ক সেখানে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে আগ্রহী। দুটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত লক্ষ্য সিরিয়ার ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ইসরায়েলের সিরিয়া নীতি মূলত তাদের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ থেকে উদ্ভূত। ঐতিহাসিকভাবে, ইসরায়েল সিরিয়ার আসাদ সরকারকে লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের মত তাদের প্রধান শত্রুদের সমর্থনকারী হিসেবে দেখেছে। সিরিয়া ইরানের অস্ত্র সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অধিকন্তু, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত গোলান মালভূমি ইসরায়েলের জন্য একটি কৌশলগত স্থান, যার নিয়ন্ত্রণ তারা কোনোভাবেই হারাতে চায় না। সিরিয়ার অভ্যন্তরে যে কোনো ইসরায়েলবিরোধী শক্তির উত্থান, বিশেষত গোলান সীমান্তের কাছে তা ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি। এ কারণেই ইসরায়েল নিয়মিতভাবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে সন্দেহভাজন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়, যার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে এমন অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করা এবং সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করে রাখা।
তুরস্কের সিরিয়া নীতি বহুস্তরের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের সীমান্ত নিরাপত্তা। তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটকে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির একটি শাখা হিসেবে দেখে, যা তুরস্ক এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। সিরিয়ায় কুর্দিদের শক্তিশালী উপস্থিতি তুরস্কের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা হুমকি। তুরস্কের সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো এই কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে তাদের প্রভাব কমানো এবং একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি করা, যেখানে সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে তুরস্ক তাদের সীমান্ত সুরক্ষিত করতে চায়। এছাড়াও, তুরস্ক আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা এমন একটি সরকার দেখতে চায় যা তুরস্কের স্বার্থের অনুকূল এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনও তুরস্কের অন্যতম লক্ষ্য।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক ঘাঁটির বিস্তারকে একটি ‘রেড লাইন’ হিসেবে বিবেচনা করে। এর কারণ হলো, ইসরায়েল মনে করে, সিরিয়ায় তুরস্কের স্থায়ী এবং শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি তাদের আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিক সামরিক আধিপত্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, যদি তুরস্ক সিরিয়ার বিমান ঘাঁটিগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বা উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করে, তবে ইসরায়েলের জন্য সিরিয়ার আকাশসীমায় নির্বিঘ্নে নজরদারি ও অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না, যা উভয় দেশের মধ্যে একটি সরাসরি এবং ভয়াবহ সংঘাতের সূচনা করতে পারে। এমন সংঘাতের ফলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
সম্প্রতি আজারবাইজানের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে গোপন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল উভয় দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কমানো এবং সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো। তবে, উভয় দেশের মৌলিক স্বার্থ এবং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকর সমাধানকে কঠিন করে তুলেছে। সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে এই দুটি আঞ্চলিক শক্তি কীভাবে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করে এবং একই সাথে সম্ভাব্য বৃহত্তর সংঘাত এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয় তার উপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গভীর উদ্বেগের সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।