পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এসব হামলায় অন্তত আটজন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে তিন বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। ভারত দাবি করেছে যে তাদের ‘অপারেশন সিন্দুর’ এর মাধ্যমে নয়টি সন্ত্রাসী অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছয়টি শহরকে লক্ষ্য করে আঘাত হানে। এর মধ্যে পাঞ্জাব প্রদেশের চারটি ভিন্ন স্থান রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম ভারত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল এই প্রদেশে হামলা করলো। বাকি দুটি লক্ষ্যস্থল ছিল মুজাফফারাবাদ এবং কোটলি, উভয়ই পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে অবস্থিত।
এই হামলার জবাবে পাকিস্তান তাদের যুদ্ধবিমানগুলোকে আকাশে পাঠায় এবং পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। যদিও ভারত এখনো এই দাবির বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ভারতীয় হামলা গত ২২শে এপ্রিল মনোরম পহেলগামে পর্যটকদের ওপর মারাত্মক হামলার ১৫ দিন পর ঘটলো। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ এই হামলায় তাদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
পহেলগামের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পরমাণু শক্তিধর এই প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভারত পাকিস্তানের কোথায় আঘাত হেনেছে?
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বুধবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে জানান, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাঞ্জাবের চারটি স্থান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের দুটি স্থানে আঘাত হেনেছে। হামলাটি বুধবার স্থানীয় সময় আনুমানিক রাত একটায় ঘটে।
সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুর শহরের কাছে আহমেদপুর শারকিয়ায়। শরীফ চৌধুরী আরও জানান, এখানে একটি মসজিদের কম্পাউন্ডে আঘাত করা হয়েছে এবং তিন বছর বয়সী একটি মেয়েসহ পাঁচজন নিহত হয়েছে।
পাঞ্জাবের অন্যান্য যেসব স্থানে হামলা হয়েছে সেগুলো হলো মুরিদকে শহর, সিয়ালকোট শহরের কাছে একটি গ্রাম এবং শাকারগড়।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের দুটি স্থান মুজাফফরাবাদ ও কোটলিও আক্রান্ত হয়েছে এবং দুটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। হামলায় ১৬ বছর বয়সী এক মেয়ে ও ১৮ বছর বয়সী এক ছেলে নিহত হয়েছে।
আহমেদ শরীফ বলেন, হামলায় অন্তত আটজন পাকিস্তানি নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়েছেন। পাঞ্জাব প্রদেশ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে, হাসপাতাল ও নিরাপত্তা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে এবং বুধবার স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
ভারতীয় হামলার পরপরই পাকিস্তান রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে এবং তাদের যুদ্ধবিমান আকাশে উড্ডয়ন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ সামাজিক মাধ্যম এক্সে পোস্ট করে বলেন, ভারতকে ‘জবাব দেওয়া হচ্ছে।’
রাতারাতি পাকিস্তান বেশ কিছু দাবি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে তিনটি রাফালসহ পাঁচটি পর্যন্ত ভারতীয় জেট তারা ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও একই দাবি জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আরও জানিয়েছে, ভারত তাদের সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র ভারতীয় আকাশসীমা থেকে নিক্ষেপ করেছে। পাকিস্তান যদি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে থাকে, তবে তারা ভারতীয় আকাশসীমার ভেতরে থাকা অবস্থায় সেগুলোকে গুলি করেছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনো এই দাবিগুলোর বিষয়ে বা হামলায় অংশ নেওয়া সমস্ত ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান নিরাপদে তাদের নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরেছে কিনা সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ভারত কেন পাকিস্তানে হামলা করলো?
পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে সংঘাতের এই নতুন ধাপটি শুরু হয়েছে ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগাম অঞ্চলের বাইসারান উপত্যকায় হামলার পর। ভারত বহু বছর ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন, অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণে সহায়তার অভিযোগ তুলে আসছে। তবে পাকিস্তান জোর দিয়ে বলেছে যে তারা কাশ্মীরী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে কেবল নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে।
গত মাসের হামলার পর, ভারত দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামক একটি অস্পষ্ট গোষ্ঠীকে দায়ী করে এবং দাবি করে যে এটি পাকিস্তান-সমর্থিত একটি গোষ্ঠী এবং সেখানে তাদের নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে। পাকিস্তান এই ঘটনার নিন্দা জানালেও তাদের জড়িত থাকার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে এবং ঘটনার ‘স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য, নিরপেক্ষ’ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
এর আগেও ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় ২০১৬ ও ২০১৯ সালে পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে ভারত। সম্প্রতি পহেলগামে হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘কাশ্মীর হামলাকারীদের পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অনুসরণ করবে ভারত।’
পহেলগাম হামলার পর থেকে উত্তেজনা কীভাবে বেড়েছে?
২২শে এপ্রিলের পর থেকে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে, যার ফলস্বরূপ ইতোমধ্যেই সীমিত কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে গেছে।
- ভারত সিন্ধু জলচুক্তি থেকে তাদের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে, যার অধীনে তারা পাকিস্তানের সাথে ছয়টি নদীর জল ভাগ করে নেয়। যেহেতু ভারত উচ্চ অববাহিকার রাষ্ট্র, তাই তারা তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তানের প্রাপ্য এবং নির্ভরশীল জলের সরবরাহ সীমিত করতে পারে। ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা বাতিল করেছে।
- পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে।
- উভয় দেশ একে অপরের কূটনীতিক ও নাগরিকদের বহিষ্কার করেছে এবং দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং আকাশসীমাও বন্ধ করে দিয়েছে।
- ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে, কর্তৃপক্ষ ২০০০ জনেরও বেশি বাসিন্দাকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কথিত জঙ্গিদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে।
ভারত কেন এটিকে ‘অপারেশন সিন্ধুর’ নাম দিয়েছে?
ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নামকরণ করেছে “অপারেশন সিন্দুর”। এই নামটি তাৎপর্যপূর্ণ।
“সিন্দুর” বলে সিঁদুর বোঝানো হয়েছে, একটি লাল রঙের রঞ্জক যা বিবাহিত হিন্দু মহিলারা তাদের কপালে লাগান। বন্দুকধারীরা পুরুষ পর্যটকদের মহিলাদের থেকে আলাদা করেছিল এবং তারপরে বিশেষভাবে যারা অমুসলিম ছিল তাদের চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করেছিল, তাদের হিন্দু স্ত্রীদের বিধবা করে রেখে গিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর সাধারণত মহিলারা সিঁদুর পরা বন্ধ করে দেন।