এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও বিনোদন জগতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই ছিল শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ। কিন্তু ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনের পর থেকে সে মূল্যবোধ প্রশ্নের মুখে। নানা স্তরের শিল্পী, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী, লেখক, নির্মাতা ও কারিগরি কর্মীরা অভিযোগ করছেন, গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের বিরোধিতা করলেই চাকরি হারানো বা ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
চুপ থাকাই এখন নিরাপদ!
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সংস্কৃতিকর্মীর দাবি, তারা সরাসরি চাকরি হারিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগই পাননি শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “ফ্রি প্যালেস্টাইন” লেখার কারণে। ‘স্নো হোয়াইট’-এর অভিনেত্রী র্যাচেল জেগলার কিংবা ‘নো আদার ল্যান্ড’ চলচ্চিত্রের পরিচালক হামদান বল্লাল, দুজনই এর শিকার।
অস্কারজয়ী বল্লালকে ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনারা আটক করে। কিন্তু অস্কার দেওয়া একাডেমি বরং কৌশলে এড়িয়ে যায় প্রতিবাদ। আবার র্যাচেল জেগলার যখন ফিলিস্তিনের পক্ষে টুইট করেন, তখন প্রযোজকরা তাঁর ওপর দোষ চাপান ছবির বাজে ব্যবসার জন্য।
গোপন নজরদারি ও কর্মী বাছাইয়ের অন্য নীতি
অনেক টিভি লেখক ও অভিনেতা অভিযোগ করেছেন, নিয়োগের আগে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্যান করা হচ্ছে।
কারা ইসরায়েলের সমালোচনা করছে, তা চিহ্নিত করে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাদের এজেন্ট বা ম্যানেজার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ‘ভিন্ন মত’ প্রকাশের কারণে। তবে কেউই মুখ খুলতে পারছেন না প্রতিশোধ বা অপমানের ভয়ে।
নিউইয়র্কভিত্তিক একজন নৃত্যশিল্পী বলেন, ‘নৃত্যজগতে একটা প্রকৃত ব্ল্যাকলিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ আরেক অভিনেতা বলেন, ‘এজেন্সিগুলো একসঙ্গে বসে ঠিক করছে কে বাদ পড়বে।’
শিল্পী ইউনিয়নের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ
যেখানে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ইউনিয়ন থাকা উচিত, সেখানেও অনেকে বলছেন, ‘শান্তিচুক্তি দাবিকারী’ সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়নি ইউনিয়নগুলো, বরং অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়নের নেতারাই ফিলিস্তিনপন্থী সদস্যদের দমন করছে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব থিয়েট্রিকাল স্টেজ এমপ্লয়িজ-এর এক সদস্য জানান, তারা যখন ‘গণহত্যার প্রতিবাদে’ প্রস্তাব আনতে যান, তখন ইউনিয়নের নির্বাচিত নেতারা “ভয়ভীতি, মিথ্যাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার” করেছেন। এমনকি ইসলামবিদ্বেষী কনটেন্ট ছড়াতেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইতিহাসও একই ধারা বহন করে
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম আন্দোলনের ইতিহাসও এই বিতর্কের পেছনে প্রাসঙ্গিক। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড রিগ্যানের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সবসময়ই ইউনিয়নগুলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বা ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখনো সেই ঐতিহ্য বহমান, যেখানে ফিলিস্তিনের জন্য কথা বললেই ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রতিরোধও গড়ে উঠছে
তবুও নীরবতায় আটকে থাকেননি সবাই। ‘থিয়েটার ওয়ার্কার্স ফর সিজফায়ার’, ‘ড্যান্সার্স ফর প্যালেস্টাইন’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব থিয়েট্রিকাল স্টেজ এমপ্লয়িজ ফর প্যালেস্টাইন’ এর মতো গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা শিল্প ও সংস্কৃতি জগত থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, বয়কটের ডাক দিচ্ছে, বিকল্প উৎসব আয়োজন করছে যেমন ‘নিউইয়র্ক কাউন্টার ফিল্ম ফেস্টিভাল’, যা মূলধারার প্রো-ইসরায়েল উৎসবের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে।
বহু শিল্পী জানিয়েছেন, আগে তারা মুসলিম বা আরব চরিত্রে কেবল সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অডিশন দিতেন। অভিনেতা আমিন এল-গামাল বলেন, ‘নিজেকে নিয়ে লজ্জা লাগে, কিন্তু তখন মনে হতো এছাড়া কোনো পথ নেই।’ এখন তারা নতুন গল্প বলার চেষ্টা করছেন, ফিলিস্তিনি জীবনের বাস্তবতা ও মানবিক দিকগুলো তুলে ধরতে চাইছেন।
যতই দমন আসুক, যতই ক্যারিয়ার থমকে যাওয়ার হুমকি থাকুক—যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-সংস্কৃতি জগতে একটি নীরব কিন্তু শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে উঠছে। ফিলিস্তিনের জন্য, ন্যায়ের জন্য এবং শিল্পের আসল দায়িত্ব পালনের জন্য। এই আন্দোলন এখন শুধুই ফিলিস্তিন নয়, বরং মতপ্রকাশের অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য এক বড় যুদ্ধ।