২৭ বছর আগে আজকের দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেট এক মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ১৭ই মে, সেদিন ওডিআই ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সোনালী অধ্যায়ের পথে। ভারতের হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে কেনিয়াকে হারিয়ে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছিল আকরাম খানের টিম টাইগার।
ঐতিহাসিক সেই জয়ের কারিগর ছিলেন আতহার আলী খান আর মোহাম্মদ রফিক। আতহার নিয়মিত ইনিংস ওপেন করলেও সেদিনই প্রথম মোহাম্মদ রফিককেও নামানো হয় ওপেনিংয়ে। প্রথমবার ওপেন করতে নেমেই বাজিমাত করেছিলেন রফিক। সে সময়ের কেনিয়ার বাঘা বাঘা বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে তুলে নেন ৭৭ রান। ৮৭ বল খেলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ছিল রফিকের ঐতিহাসিক ইনিংসটি। সে ম্যাচে তার বাঁ হাতের ঘূর্ণিতে কুপোকাত হয়েছিল কেনিয়ার তিন ব্যাটার। ম্যাচে শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও শোভা পাচ্ছিল তার হাতে।
সেদিন মারকুটে রফিকের সাথে ঠান্ডা মাথায় খেলছিলেন আতহার। ৯১ বল খেলে করেন ৪৭ রান। দুজনের উদ্বোধনী জুটিতে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ১৩৭। সে জুটিতে ভর করেই ২৩৭ রান তাড়া করে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছায় …. ইনজুরি আক্রান্ত অধিনায়ক আকরাম খান সেদিন পেইনকিলার ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামেন। ৫১ বল খেলে করেছিলেন ৩৯ রান।
পরে আমিনুল ইসলাম বুলবুল আর নাইমুর রহমান দুর্জয় দুই ওভার হাতে রেখেই ৬ উইকেটে বাংলাদেশকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। ম্যাচ শেষে গর্ডন গ্রিনিজের শীষ্যদের উচ্ছ্বাস যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো আছড়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। সেদিন রেডিওতে বেজে ওঠা খোদা বাক্স মৃধা আর চৌধূরী জাফুরুল্লাহ শরাফতের কণ্ঠে ঝরা আবেগ উদ্বেলিত করেছিল ক্রিকেটপাগল বাঙালিকে।
ঐতিহাসিক সেই একাদশে ছিলেন: আতহার আলী খান, মোহাম্মদ রফিক, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান (অধিনায়ক), নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন, এনামুল হক মণি, হাসিবুল হোসেন শান্ত, খালেদ মাসুদ পাইলট এবং মোর্শেদ আলী খান।
প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে জয়ের সেই নায়করা আজ কে কোথায়?
আতহার আলী খান: ক্রিকেট মাঠ থেকে দূরে যাননি আতহার আলী খান। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক সিরিজেই তাকে ধারাভাষ্যকক্ষে দেখা যায়। শুধু দেশেই নয়, বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও তিনি একজন পরিচিত কণ্ঠ। এমনকি পাকিস্তানের জনপ্রিয় লিগ পিএসএলেও তিনি ধারাভাষ্য দিয়েছেন।
মোহাম্মদ রফিক: হার্ড-হিটিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ রফিক খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কিছুদিন বিসিবির হাই পারফরম্যান্স বিভাগের স্পিন কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিপিএলের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সর্বশেষ বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের স্পিন বোলিং কোচের ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। বর্তমানে কেরানীগঞ্জে নিজের ব্যবসা নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটান এই লড়াকু ক্রিকেটার।
মিনহাজুল আবেদীন: মিনহাজুল আবেদীন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচক প্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। প্রধান নির্বাচকের দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। বর্তমানে তিনি বিসিবির প্রোগ্রাম হেডের দায়িত্বে নিয়োজিত।
আমিনুল ইসলাম: বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুলও ক্রিকেটের সাথেই আছেন, তবে সরাসরি দেশের বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো দায়িত্বে নয়। তিনি পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। এর আগে আইসিসিতে ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সাথে যুক্ত।
আকরাম খান (অধিনায়ক): ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ী দলের অধিনায়কের নেতৃত্বেই এসেছিল বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম সেই ঐতিহাসিক জয়। পিঠের চোটে আগের ম্যাচ খেলতে না পারলেও, এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন এবং ব্যাট হাতে করেছিলেন মূল্যবান ৩৯ রান। আকরাম খান এখনো ক্রিকেটের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বিসিবির প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পরবর্তীতে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন। এক যুগেরও বেশি সময় তিনি বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন।
নাঈমুর রহমান: সেই ম্যাচে ৪ রানে অপরাজিত ছিলেন নাঈমুর রহমান। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ২০০০ সালে তাদের ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে তিনি জড়িয়েছিলেন রাজনীতিতে এবং দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবে গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তাকে আর তেমন প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
খালেদ মাহমুদ: খেলা ছাড়ার পর খালেদ মাহমুদ সুজন ক্রিকেটের বিভিন্ন ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরেছেন। কখনো বিসিবির পরিচালক, আবার কখনো জাতীয় দলের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারের দায়িত্বের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত কোচের ভূমিকাও পালন করেছেন তিনি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ এবং বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) কোচ হিসেবে নিয়মিত দেখা যায় এই সাবেক অলরাউন্ডারকে।
এনামুল হক: খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানানোর পর এনামুল হক মনি দীর্ঘ সময় আম্পায়ারিং করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার যিনি পরবর্তীতে টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্বও পালন করেছেন। আম্পায়ারিং ছেড়ে দেওয়ার পর বর্তমানে তিনি আম্পায়ারদের প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিয়োজিত।
হাসিবুল হোসেন: বাংলাদেশের হয়ে ৩৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক হিসেবে কাজ করছেন। ক্রিকেট নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী টেলিভিশন টক শোতেও তাকে নিয়মিত দেখা যায়।
খালেদ মাসুদ: জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ পাইলট এখন নিজের ব্যবসা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সম্প্রতি তিনি রেস্টুরেন্ট ও আম বাগানের ব্যবসাও শুরু করেছেন। ঢাকা এবং রাজশাহীতে তার নিয়মিত যাতায়াত। বিসিবির সর্বশেষ নির্বাচনে পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন তিনি।
মোর্শেদ আলী খান: বাংলাদেশের হয়ে মাত্র তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা বাঁহাতি পেসার মোর্শেদ আলী খান বর্তমানে আইসিসির প্যানেল আম্পায়ার। তিনি ২০টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন। এছাড়াও নারী ক্রিকেটের ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ৯টি ম্যাচেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। মাঠের বাইরে এই সাবেক পেসারের আরও একটি পরিচয় রয়েছে- তিনি বেশ ভালো গানও গান।
আজকের এই দিনে, ১৯৯৮ সালের সেই ঐতিহাসিক জয়ের ২৭ বছর পূর্তিতে, আমরা সেই ১১ জন যোদ্ধাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি, যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এনে দিয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক জয়ের অমূল্য স্বাদ। তাদের সেই কীর্তিগাথা আজও কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে অমলিন।
আতহার আলী খান এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকক্ষে নিয়মিত মুখ। মোহাম্মদ রফিক কোচিংয়ের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায় সময় দেন। মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বিসিবির প্রোগ্রাম হেডের দায়িত্বে। আমিনুল ইসলাম বুলবুল কাজ করছেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে। অধিনায়ক আকরাম খান এখন বিসিবির পরিচালক। নাঈমুর রহমান দীর্ঘ সময় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। খালেদ মাহমুদ সুজন ক্রিকেট কোচিং ও প্রশাসনে সক্রিয়। এনামুল হক মণি এখন আম্পায়ারদের প্রশিক্ষক। হাসিবুল হোসেন শান্ত বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক। খালেদ মাসুদ পাইলট নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আর মোর্শেদ আলী খান বর্তমানে আইসিসির প্যানেল আম্পায়ার।
সেই ১১ জন বীর, যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা ক্রিকেট ভক্তদের। ঐতিহাসিক ওই জয়গাঁথা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অম্লান থাকবে চিরকাল ।