সময়ের জনমাধ্যম

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে কূটনৈতিকভাবে লাভবান উপসাগরীয় দেশগুলো

ইসরায়েল-ইরান সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো। বিশ্লেষক ও আরব কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সংঘাতে দুই প্রধান শক্তি ইসরায়েল ও ইরান উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হলেও তুলনামূলকভাবে বেশ নিরাপদ অবস্থানে ছিল সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই কূটনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে একদিকে ইসরায়েলের উপর চাপ বাড়াতে, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রস্তুত এই দেশগুলো।


‘অজেয়’ ইসরায়েলের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে

ইসরায়েল এই সংঘাতে সামরিকভাবে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, বাস্তবতা হলো, তাদের মূল ভূখণ্ড টানা দুই সপ্তাহের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সহ্য করতে পারেনি। এক আরব কর্মকর্তা বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা সাহস দেখিয়েছে, কিন্তু দেশটির অভ্যন্তরীণ ফ্রন্ট এই মাত্রার সংঘাত আর নিতে পারত না।’ কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাদর আল সাইফ বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাব দিয়েছে। অজেয় ও দুর্ভেদ্য ইসরায়েলের ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়েছে।’ এই উপলব্ধি উপসাগরীয় দেশগুলোর ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে প্রস্তুত উপসাগরীয় নেতারা

আরব কর্মকর্তারা জানান, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, উপসাগরীয় দেশগুলো এখন তাদের সঙ্গে বিনিয়োগ এবং উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আগ্রহী। চলতি বছরের শুরুতে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী তেহরান সফর করেছেন। এক আরব কূটনীতিক জানান, ‘আমাদের ওয়াশিংটনে একটা সরাসরি কণ্ঠ আছে। সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে এখন আমরা তেহরানের কাছেও গুরুত্ব পাচ্ছি।’ বিশ্লেষক আয়হাম কামেল বলেন, ‘এই সংকটে উপসাগরীয় দেশগুলো পর্দার আড়ালে কূটনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইরান, তুরস্ক ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করেছে।’


গাজা যুদ্ধ, জনগণের মনোভাব ও ‘স্বাভাবিকীকরণ’ প্রশ্নে নতুন চ্যালেঞ্জ

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে নতুন করে ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে। গাজা যুদ্ধ ও তাতে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনির প্রাণহানি উপসাগরীয় জনমতকে প্রভাবিত করেছে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী, গাজার যুদ্ধের প্রথম দিকেই সৌদি জনগণের ৯৬ শতাংশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।


প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছেন বলে জানানোর পাশাপাশি সৌদি আরবের ওপর সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের জন্য চাপ কমিয়ে এনেছেন। তবে সৌদি নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে বলেছে, ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়া কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।’


উপসাগরীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের ছাপ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সৌদি আরব এখন পূর্বের ধর্মীয় রণনীতির বদলে বাস্তববাদী কৌশল অনুসরণ করছে। দেশটির ভিশন ২০৩০-এর আওতায় সামাজিক সংস্কার, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ‘মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়াহাবিবাদ থেকে সরে এসেছেন,’ বলেন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক প্যাট্রিক থেরোস। ‘ এই পরিবর্তন ইসরায়েলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, কারণ এখন আর ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে রণনীতি তৈরি করা যাচ্ছে না।’


ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। যারা আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ ছিল, তারাও এখন ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে আগ্রহী। একই সঙ্গে গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং আরব বিশ্বে সমর্থন হারিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলো চতুর কূটনীতির মাধ্যমে নিজেদের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব আরও বাড়াতে চাইছে।