নিশীথ রাতে বাতাস চিরে যায় অদৃশ্য নীরব এক ঘাতক। বিশ্বের সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে এই অজানা ছায়া পৌঁছে যেতে পারে লক্ষ্যে। এর বহনযোগ্য ধ্বংসাত্মক শক্তি এমন যে মুহূর্তে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে। প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। রহস্যময় যুদ্ধযানটির নাম বি-২ স্পিরিট, ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিমান। এই বিমানের ডানার প্রস্থ ৫০ মিটার। এত বড় একটি বিমানের রাডারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব? আর কেনই বা দেখতে এতটা ভবিষ্যত-প্রযুক্তিতে সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র থেকে উঠে আসা বলে মনে হয়?
তৈরির পটভূমি
১৯৭৫ সাল। শীতল যুদ্ধ তুঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারমাণবিক উত্তেজনা চরমে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের বি-৫২ বোমারু বিমানগুলো বিশাল বোমার বোঝা নিয়ে আকাশে সর্বদা প্রস্তুত থাকত, প্রয়োজনে সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকে হামলা চালাতে।
কিন্তু সমস্যার শুরু হয় যখন সোভিয়েতরা অত্যাধুনিক বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে একজন মার্কিন জেনারেল ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত সীমান্তে বি-৫২ পাঠানো মানে একটি পাথর ছুঁড়ে দেওয়া, তাও ঘাড়ে লাল টার্গেট চিহ্ন আঁকা অবস্থায়।’
তখনই যুক্তরাষ্ট্র হাতে নেয় এডভান্স ট্যাকনোলজি বোম্বার (ATB) প্রোগ্রাম। যার লক্ষ্য ছিল এমন এক বিমান তৈরি করা যা রাডার ফাঁকি দিয়ে পৃথিবীর যেকোন স্থানে আঘাত হানতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানের সূত্রপাত হয়েছিল আরও আগেই, ১৯৪০-এর দশকে। মার্কিন প্রকৌশলী জ্যাক নর্থরপ কল্পনা করেছিলেন এক “ফ্লাইং উইং” সম্পূর্ণ ডানা আকৃতির বিমান, যেটার কোনও লেজ বা মূল কাঠামো নেই।

তার তৈরি ওয়াই বি-৪৯ উড়েছিল ১৯৪৭ সালে, কিন্তু সেই সময়ের প্রযুক্তি দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ১৯৪৯ সালে প্রকল্প বাতিল হয় এবং সব বিমান ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
তবে ১৯৭৮ সালে আবার সেই ডিজাইনের ওপর ভর করেই নর্থরপ কোম্পানি ATB প্রোগ্রামের দায়িত্ব পায়। যুগান্তকারী প্রযুক্তি ও সরকারের উন্মুক্ত চেকবই নিয়ে শুরু হয় বি-২ স্পিরিটের নির্মাণকাজ।
যে কারণে এ বিমান অদৃশ্য থাকে
- পুরো বিমানের ডিজাইন ডানার মতো—ফিউজেলাজ নেই, লেজ নেই।
- এই ডিজাইন রাডারে বিমানের প্রতিফলন ক্ষমতা প্রায় শূন্য করে দেয়।
- এটির রাডার ক্রস সেকশন এতটাই ছোট, রাডারে ধরা পড়ে না বললেই চলে।
- বিমানের গায়ে থাকে রাডার এবসরবেন্ট ম্যাটেরিয়াল (RAM), যা রাডার সিগনাল শোষণ করে ফেলে।
- এর গঠন এতটাই মসৃণ ও নিখুঁতভাবে জোড়া দেওয়া যে কোথাও কোনো কোণ বা ফাঁক পাওয়া যায় না।
- অত্যাধুনিক এই বিমানের ইঞ্জিনগুলো খোলসের ভেতর লুকানো থাকে যেন নিচ থেকে রাডার বা তাপ সনাক্তকরণ যন্ত্রে ধরা না পড়ে।

প্রযুক্তি ও কর্মক্ষমতা
বৈশিষ্ট্য | তথ্য |
রেঞ্জ (রিফুয়েলিং ছাড়া) | প্রায় ১১,০০০ কিমি |
রেঞ্জ (রিফুয়েলিং সহ) | প্রায় বিশ্বজুড়ে |
সর্বোচ্চ উচ্চতা | ৫০,০০০ ফিট |
গতি | ঘণ্টায় ৯০০ কিমি |
বোমা বহনের ক্ষমতা | ২০ টন |
অস্ত্র | নিউক্লিয়ার ও সাধারণ বোমা, GPS-guided JDAM, GBU-57 Bunker Buster |
ক্রু সংখ্যা | ২ জন (পাইলট ও মিশন কমান্ডার) |
কেন এত ব্যয়বহুল?
- প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। ১৯৮০-এর দশকে তৈরি হলেও এটিই সবচেয়ে আধুনিক বোম্বার বিমান। এ বিমান তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ এত ব্যয়বহুল হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে:
- প্রযুক্তির গোপনীয়তা
- সীমিত উৎপাদন (২১টি)
- নিয়মিত মেরামত ও স্কিন পরিবর্তনের খরচ
- সর্বশেষ সফটওয়্যার ও সিস্টেম আপগ্রেড
- প্রযুক্তির গোপনীয়তা

যুক্তরাষ্ট্র থেমে নেই, তারা পরবর্তী প্রজন্মের বোমারু বিমান তৈরির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আসছে বি-২১ রেইডার, যা হবে হবে বি-২ এর উত্তরসূরি, আরও ছোট, কম দামে তৈরি এবং সহজে রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য। এটি হবে ষষ্ঠ প্রজন্মের বোমারু বিমান, যার কাজ হবে শুধু আক্রমণ নয়, গোয়েন্দাগিরিও।