বাশার সরকারের পতনের পর নতুন করে সিরিয়ায় উত্তেজনা দেখা গেছে, বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহ ধরে দামেস্কের উপকণ্ঠে জারামানা এবং আশরাফিয়াত সাহনায়া অঞ্চলে ক্রমেই সংঘাত বেড়ে চলেছে। এ সংঘর্ষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ ও নতুন প্রশাসনের অধীনে দেশটির স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
প্রাথমিকভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি বিতর্কিত অডিও রেকর্ডিংকে এই অস্থিরতার কারণ মনে করা হচ্ছে। রেকর্ডিংয়ে মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে এটি একজন দ্রুজ নেতার কণ্ঠস্বর। যদিও এই রেকর্ডিং-এর সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, এটি অনেক সিরীয় নাগরিকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
মঙ্গলবার, এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে জারামানায়। সেখানে মূলত সিরিয়ার সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের বসবাস। অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা শহরটিতে হামলা চালায়। সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী এই গোলযোগ থামাতে হস্তক্ষেপ করে, কিন্তু সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের মতে, তারাও পাল্টা হামলার শিকার হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং দ্রুজ যোদ্ধারাও রয়েছেন।

সহিংসতা দামেস্কের কাছে আরেকটি শহর আশরাফিয়াত সাহনায়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সাহনায়ায় একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলায় তাদের ১৬ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। ফলে সংঘর্ষ জটিল আকার ধারণ করে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, এই সংঘাতে ছয়জন দ্রুজ যোদ্ধাও নিহত হয়েছে।
তবে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপে। “দ্রুজদের রক্ষা” করার অজুহাতে ইসরায়েলি বাহিনী সাহনায়ায় বিমান হামলা চালায়। সিরীয় কর্তৃপক্ষের মতে, এই হামলায় নিরাপত্তা কর্মীদের লক্ষ্য করা হয়েছিল, যদিও ইসরায়েল দাবি, তারা “উগ্রবাদী” নিধনের উদ্দেশ্যে হামলা চালায়।
এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় প্রশ্ন উঠছে- এই সহিংসতার কারণ কী? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নতুন প্রশাসনের দুর্বলতাই এর মূল কারণ। ডিসেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, সরকার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। অসংখ্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সহজাত অস্থিরতা দেশটিতে বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করেছে। গেল মার্চ মাসের শুরুতে উপকূলীয় অঞ্চলে আসাদ সরকারের অনুগত বাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে শত শত মানুষ নিহত হয়েছিল। এই ঘটনাটি দেশব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নতুন সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

এই উত্তেজনা আল-আউয়াইত এবং দ্রুজদের মতো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সন্দেহও বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, এই সম্প্রদায়গুলো সম্ভাব্য নিপীড়ন এবং উগ্রপন্থী যোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। যদিও নতুন সরকার সকল সিরীয় নাগরিকের জন্য সমতার উপর জোর দিয়েছে, কিন্তু দুর্বল প্রশাসনের ওপর অনাস্থার এই উদ্বেগ পুরোপুরি প্রশমিত হচ্ছেনা।
এই জটিল পরিস্থিতিতে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বিতর্কিত অডিওটি, যেমন সেই বিতর্কিত অডিও রেকর্ডিং জারামানা এবং আশরাফিয়াত সাহনায়ার ঘটনার মতো সহিংসতা উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
সবশেষে, ইসরায়েলের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আসাদ সরকারের পতনের পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ায় তাদের সামরিক অভিযান বাড়িয়েছে, যা গোলান মালভূমিতে তাদের বিদ্যমান দখলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েল তাদের প্রভাব বিস্তারের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে এটিকে, নতুন সিরীয় সরকারকে “উগ্রপন্থী” হিসেবে চিত্রিত করে দ্রুজ সংখ্যালঘুদের রক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের জাহির করছে, যাদের কিছু অংশ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে বসবাস করে। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দামেস্কের কাছে সিরীয় সরকারি বাহিনীর কার্যকলাপের বিরোধিতা করেছেন এবং এলাকাটিকে সামরিকীকরণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাহলে, দ্রুজ কারা এবং এই পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান কী? দ্রুজ হলো একটি আরবি-ভাষী জাতিগত-ধর্মীয় গোষ্ঠী যারা মূলত ইসমাঈলি শিয়া মতাবলম্বীর। জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইসরায়েলে, প্রধানত দখলকৃত গোলান মালভূমিতে এই সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। তাদের আনুগত্য সম্পর্কে সাধারণীকরণ করা ভুল হবে। ইসরায়েলের দ্রুজরা দেশটির সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করে, তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্রুজরা সাধারণত ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে। ঐতিহাসিকভাবেই সিরিয়ার দ্রুজ নেতারা ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।
সিরিয়ার পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। সাম্প্রতিক সহিংসতা গভীর উত্তেজনা, বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতের পর স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থ হাসিলের প্রবণতা দেশটির নতুন সরকারকে নানাবিধ চাপের মধ্যে রেখেছে। জারামানা এবং আশরাফিয়াত সাহনায়ায় সংঘাত কিছুটা স্তিমিত হলেও অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো এখনও বিদ্যমান, যা সিরিয়ার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।