সময়ের জনমাধ্যম

তিন সাংবাদিক বরখাস্ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ

বেসরকারি তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের তিন সাংবাদিককে অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে মঙ্গলবার থেকে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে বিতর্কিত প্রশ্ন করার পরদিন তড়িঘড়ি করে তাদের চাকরিচ্যুত করায় সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যম মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

বরখাস্ত হওয়া তিন সাংবাদিক হলেন– এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বি, চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রফিকুল বাসার ও দীপ্ত টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রহমান মিজান।

এটিএন বাংলা তাদের বিশেষ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বিকে চাকরি থেকে বরখাস্তের এক চিঠিতে জানায়, যথাযথ পেশাগত দায়িত্ব পালন না করার কারণে মঙ্গলবার থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে, অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, এর আগে মানবিক কারণে বিশেষ বিবেচনায় চাকরিতে পুনর্বহাল করা হলেও রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের অভাব দেখা যাওয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ফজলে রাব্বি ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে “জুলাই আন্দোলনে শহিদদের নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন করতেন।

দীপ্ত টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রহমান মিজানের বরখাস্তের চিঠিতে কোনো কারণ উল্লেখ না করে সরাসরি বলা হয়েছে, ‘আপনাকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো’ এই বরখাস্তের ঘটনা সংবাদ সম্মেলনে তার প্রশ্ন তোলার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।

চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে পেশাদারিত্ব প্রদর্শন না করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রফিকুল বাসারের বিষয়ে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষের তদন্ত শুরু হয়েছে এবং তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে দীপ্ত টিভির স্ক্রলে ‘অনিবার্য কারণবশত দীপ্ত টিভির সকল সংবাদ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হলো’ বলে একটি স্ক্রল দেখানো হয়। যদিও পরে রাত ১১টা থেকে চ্যানেলটি পুনরায় সংবাদ সম্প্রচার শুরু করে। দীপ্ত টিভির হেড অব নিউজ এসএম আকাশ এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, এটি তাদের ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত এবং আজকের দুপুর থেকে কার্যকর হয়েছে।

সোমবার সচিবালয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি সংবাদ সম্মেলনে এই তিন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন। মিজানুর রহমান তার প্রশ্নে জুলাই মাসে ১৪০০ শহীদের সংখ্যা এবং হাসিনা কে ‘খুনি’ বলার যুক্তির উৎস জানতে চান। রফিকুল বাসার চারুকলার নববর্ষের শোভাযাত্রার নকশায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি ব্যবহারের বিষয়ে উপদেষ্টার মতামত জানতে চান। ফজলে রাব্বির প্রশ্ন সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও, ধারণা করা হচ্ছে সেটিও জুলাই মাসের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।

এই ঘটনার পরপরই ‘জুলাই রেভলুশনারি অ্যালায়েন্স’ (জেআরএ) নামের একটি সংগঠন তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেয়। সংগঠনটির আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান বলেন, ‘যেসব সাংবাদিক গণহত্যার পক্ষ নিয়েও দিব্যি কাজ করে যাচ্ছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’ জেআরএ জুলাই মাসের আন্দোলন নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন এবং জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির যোদ্ধাদের নিয়ে এটি গঠিত।

তবে এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ মনিউর রহমান দাবি করেন, কোনো রিপোর্টারকে বরখাস্ত করার বিষয়ে সরকার বা জুলাই রেভলুশনারি অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে তাদের উপর কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।

সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এই বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি বলেন, তাকে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকদের চাকরি গেছে– এটি হাস্যকর কথা। তিনি আরও বলেন, তাদের চাকরির ব্যাপারে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা নেই। ফারুকী সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলোকে ‘ম্যাস মার্ডার ডিনায়াল’-এর একটি ‘সূক্ষ্ম চেষ্টা’ হিসেবেও উল্লেখ করেন ।

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সচিবালয়ে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, সরকার দীপ্ত টিভির সংবাদ কার্যক্রম বন্ধ করেনি। এটি দীপ্ত টিভি কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত। তবে তিনি এও বলেন, একজন সাংবাদিক ‘গণহত্যার পক্ষ’ নিয়ে প্রশ্ন করায় দীপ্ত টিভির সংবাদ বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

সাংবাদিকদের এই বরখাস্তের ঘটনা বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের সর্বশেষ প্রকাশিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

অন্তর্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবাদ মাধ্যমে হস্তক্ষেপের বেশ কয়েকটা ঘটনা গত নয় মাসে ঘটেছে, যার প্রেক্ষিতে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন করে, একজন সরকারি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা সাংবাদিকদের মধ্যে আরও বেশি ভীতি সঞ্চার করতে পারে। এর ফলে সাংবাদিকরা সংবেদনশীল বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে দ্বিধা বোধ করতে পারেন, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেবে বলে মত তাদের।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) বা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট অনেকেই এই ঘটনাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন ।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতির ধারায় এই ঘটনা আরও একটি কালো দাগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপের প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।