সময়ের জনমাধ্যম

কৃ্ত্রিমভাবে তৈরি হবে নভোচারীদের খাবার, পরীক্ষামূলক মিশন শুরু

মহাকাশে মহাকাশচারীদের জন্য সুস্বাদু খাবার সরবরাহ করার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। আজ কক্ষপথে উৎক্ষেপিত একটি যুগান্তকারী পরীক্ষা সফল হলে, অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশে একক কোষ থেকে স্টেক, ম্যাসড পটেটো এবং ডেজার্টের মতো খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

এই যুগান্তকারী পরীক্ষা মহাকাশে খাদ্য উৎপাদনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ মিশনের ভবিষ্যৎকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলবে বলে আশাবাদী গবেষকরা।

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেছে। প্রকল্পের অধীনে কক্ষপথ এবং অন্যান্য গ্রহে কম মধ্যাকর্ষণ এবং উচ্চ বিকিরণে ল্যাব-উৎপাদিত খাবার তৈরির প্রক্রিয়া পরীক্ষা করা হচ্ছে।

মহাকাশচারীদের খাদ্য সরবরাহের বিপুল খরচ কমাতে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এই গবেষণায় অর্থায়ন করছে। বর্তমানে একজন মহাকাশচারীর জন্য প্রতিদিন খাদ্য বাবদ প্রায় ২০,০০০ পাউন্ড খরচ হয়। এই প্রকল্পের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই পরীক্ষাটি আগামী দুই বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে একটি ছোট আকারের পাইলট খাদ্য উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ।

বেডফোর্ড ভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার স্পেসের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা ড. আকিল শামসুল, যিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকদের সাথে এই ধারণাটি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, মানবজাতিকে বহুগ্রহী প্রজাতিতে পরিণত করার নাসার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ল্যাব-উৎপাদিত খাবার অপরিহার্য।

বিবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদের স্বপ্ন হল কক্ষপথে এবং চাঁদে খাদ্য তৈরির কারখানা স্থাপন করা।”

মহাকাশে মানুষের জীবনধারণ ও কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হলে পৃথিবীর বাইরে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বর্তমানে মহাকাশচারীরা শূন্য মধ্যাকর্ষণে খেতে পছন্দ করলেও, তাদের সরবরাহ করা হিমায়িত খাবার তেমন মুখরোচক হয় না। ল্যাব-উৎপাদিত খাবারে টেস্ট টিউব এবং ভ্যাটে প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের মতো খাদ্য উপাদান তৈরি করে সেগুলোকে স্বাভাবিক খাবারের মতো স্বাদ ও চেহারায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে ল্যাব-উৎপাদিত মুরগি বিক্রি হচ্ছে এবং যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলে ল্যাব-উৎপাদিত স্টেক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পৃথিবীতে প্রচলিত কৃষিকাজের তুলনায় এই প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব বলে দাবি করা হলেও মহাকাশে এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো খরচ কমানো।

গবেষকরা জানিয়েছেন, আইএসএস-এ মহাকাশচারীদের খাবার পাঠাতে যে বিপুল খরচ হয় তা কমাতেই এই গবেষণা চালানো হচ্ছে। নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলো চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহে দীর্ঘমেয়াদী মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।

ড. শামসুলের মতে, রকেটের মাধ্যমে এত বিপুল সংখ্যক মহাকাশচারীর জন্য খাবার পাঠানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। তাই মহাকাশে খাদ্য উৎপাদন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রথমে প্রোটিন-সমৃদ্ধ ম্যাসড পটেটো এবং পরবর্তীতে আরও জটিল খাবার মহাকাশে তৈরি করতে পারি।”

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে ল্যাবে উৎপাদিত উপাদানগুলোকে থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করে মহাকাশ স্টেশনেই স্টেক-এর মতো যেকোনো খাবার তৈরি করা সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান।

পৃথিবীতে ল্যাবে উৎপাদিত স্টেক তৈরি করা গেলেও, মহাকাশে তা তৈরি করা সম্ভব কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ড. শামসুল এই প্রক্রিয়াটিকে স্টার ট্রেকের রেপ্লিকেটর মেশিনের সাথে তুলনা করেন, যা শক্তি থেকে খাদ্য ও পানীয় তৈরি করতে পারে। তবে তিনি মনে করেন, এটি আর কেবল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নয়, বরং বাস্তব হওয়ার পথে।

ইম্পেরিয়াল কলেজের বেজোস সেন্টার ফর সাস্টেইনেবল প্রোটিনসে তিনি একটি বায়োরিয়্যাক্টর দেখান, যেখানে ইটের মতো রঙের একটি তরল বুদবুদ করছিল। এই প্রক্রিয়াটি “প্রিসিশন ফারমেন্টেশন” নামে পরিচিত, যা অনেকটা বিয়ার তৈরির মতোই, তবে এখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ইস্টে অতিরিক্ত ভিটামিন তৈরির জন্য একটি জিন যোগ করা হয়েছে।

ড. রদ্রিগো লেডেসমা-আমারো জানান, এই পদ্ধতিতে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবারসহ খাবারের সমস্ত উপাদান তৈরি করা সম্ভব এবং সেগুলোকে একত্রিত করে বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করা যেতে পারে।

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি মিশনের অংশ হিসেবে স্পেসএক্স ফ্যালকন- ৯ রকেটে একটি ছোট আকারের বায়োরিয়্যাক্টর মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীতে কোষ থেকে সফলভাবে খাদ্য উৎপাদনের প্রমাণ থাকলেও, মহাকাশের ভারহীনতা ও উচ্চ বিকিরণে এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর হবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

ড. লেডেসমা-আমারো এবং ড. শামসুল সামান্য পরিমাণে ইস্টের মিশ্রণ ইউরোপের মহাকাশযান ফিনিক্সের একটি ছোট কিউবস্যাটে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠিয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এটি প্রায় তিন ঘণ্টা কক্ষপথে থাকার পর পর্তুগালের উপকূলে ফিরে আসবে। এরপর পুনরুদ্ধারকারী জাহাজ দ্বারা কিউবস্যাটটি উদ্ধার করে লন্ডনের ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।

ড. লেডেসমা-আমারো জানান, প্রাপ্ত ডাটা আগামী বছর মহাকাশে পাঠানো হবে এমন একটি বৃহত্তর ও উন্নত বায়োরিয়্যাক্টর তৈরিতে সহায়ক হবে।

তবে, গুঁড়ো করা ইটের মতো রঙের এই খাবারটি দেখতে তেমন আকর্ষণীয় নয়, এমনকি মহাকাশচারীদের বর্তমান হিমায়িত খাবারের চেয়েও কম সুস্বাদু। এখানেই ইম্পেরিয়াল কলেজের মাস্টার শেফ ইয়াকুব রাদজিকোভস্কির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রসায়নকে রন্ধনশিল্পে রূপান্তর করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত। অনুমোদন না থাকায় তিনি এখনও ল্যাব-উৎপাদিত উপাদান ব্যবহার করে মানুষের জন্য খাবার তৈরি করতে না পারলেও, প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বর্তমানে তিনি প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ছত্রাক থেকে স্টার্চ ও প্রোটিন ব্যবহার করে বিভিন্ন রেসিপি তৈরি করছেন। ল্যাব-উৎপাদিত উপাদান ব্যবহারের অনুমতি পেলে যেকোনো ধরনের খাবার তৈরি করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।

ইয়াকুব রাদজিকোভস্কি বলেন, “আমরা এমন খাবার তৈরি করতে চাই যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মহাকাশচারীদের কাছে পরিচিত হবে এবং তাদের মানসিক শান্তি দেবে।” ফরাসি, চীনা, ভারতীয়সহ যেকোনো ধরনের রান্না মহাকাশে তৈরি করা সম্ভব হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সম্প্রতি তিনি মশলাদার ডাম্পলিং এবং ডিপিং সসের একটি নতুন রেসিপি তৈরি করেছেন, যা চেখে দেখার সুযোগ হয় যুক্তরাজ্যের প্রথম নভোচারী এবং রসায়নবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রিধারী হেলেন শারম্যানের। ডাম্পলিং চেখে দেখার পর তিনি বলেন, “স্বাদের একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ অনুভব করলাম। এটি সত্যিই সুস্বাদু এবং আরও বেশি খেতে ইচ্ছে করে।” মহাকাশে থাকাকালীন তার দীর্ঘস্থায়ী, টিনজাত ও হিমায়িত খাবারের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার যদি এমন কিছু থাকত!”

ড. শার্মানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল ল্যাব-উৎপাদিত খাবারের বিজ্ঞানভিত্তিক সুবিধা নিয়ে। তিনি মনে করেন, এটি কেবল খরচই কমাবে না বরং মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো হতে পারে।

আইএসএস-এর গবেষণা অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ মিশনে মহাকাশচারীদের শরীরের জৈব রসায়নে পরিবর্তন আসে, তাদের হরমোন ও আয়রনের মাত্রা পরিবর্তিত হয় এবং হাড় থেকে ক্যালসিয়াম হ্রাস পায়। ল্যাবে উৎপাদিত খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যোগ করে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, “মহাকাশচারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার না পাওয়ায় তাদের ওজন কমার প্রবণতা দেখা যায়। তাই, হাতে তৈরি এবং স্বাস্থ্যকর খাবার পেলে তারা খাবারের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হবেন।”