সময়ের জনমাধ্যম

বাগরামে ফিরছে মার্কিন সেনারা, এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল

২০২১ সালে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। সেই সময় বাগরামের এই বিশাল বিমান ঘাঁটিটি রাতের অন্ধকারে ছেড়ে গিয়েছিল তারা। ফেলে রেখেছিল কোটি কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম, এমনকি মিত্র আফগান সেনাদেরও সে সময় ফেলে যায় মার্কিনীরা। আকস্মিক সেই বিদায় বিশ্বজুড়ে আমেরিকার সামরিক শক্তির জন্য বড় ধাক্কা ছিল।

গত ৭ই এপ্রিল ফক্স নিউজসহ বেশকিছু মার্কিন গণমাধ্যমে খবর আসে- কাবুল এবং তার আশেপাশে বিমানের অস্বাভাবিক আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। ওপেন সোর্স ফ্লাইট ট্র্যাকার থেকে জানা যায়, একটি বিশাল আমেরিকান সি-১৭ সামরিক পরিবহন বিমান বাগরামে অবতরণ করেছে। এই বিমানটি খালি ছিল না। শোনা যাচ্ছে, এটিতে সামরিক সরঞ্জাম ছিল। সাথে ছিলেন সিআইএ’র উপ-প্রধান মাইকেল এলিস ও উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

প্রশ্ন হলো, তালেবানরা কেন চাইবে আমেরিকা আবার তাদের বুকের পাথর হয়ে ফিরে আসুক?  নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো বড় সমীকরণ আছে। কিছু প্রতিবেদনে এমনও বলা হচ্ছে- তালেবান নাকি বাগরাম ঘাঁটিটি আমেরিকাকে ফেরত দিয়েছে। যদিও এ কথাকে প্রোপাগান্ডা হিসেবে উল্লেখ করে বিমানঘাঁটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে থাকার দাবি করেছে তারা।

তাহলে আসল রহস্য কী?  একটু খতিয়ে দেখা যাক। কাবুল থেকে সামান্য উত্তরে অবস্থিত এই বাগরাম বিমান ঘাঁটি একসময় আমেরিকা ও ন্যাটো সেনাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখান থেকেই তালেবান এবং অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালানো হতো। কিন্তু ২০২১ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে সব পাল্টে যায়।

আমেরিকা তাড়াহুড়ো করে আফগানিস্তান ছাড়ে এবং বাগরাম বিমান ঘাঁটি রাতের অন্ধকারে পরিত্যক্ত হয়। কাবুল দখলের কয়েক দিনের মধ্যেই তালেবান এটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

চার বছর পর, দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে ফের আলোচনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। শোনা যাচ্ছে,  মার্কিন রাষ্ট্রপতি নাকি বিমান ঘাঁটিতে আবার আমেরিকান সেনাদের ফেরাতে চান। চার বছর পর, আমেরিকা সম্ভবত সেই ভুল শুধরাতে চাইছে। ট্রাম্প তো সরাসরি বলেছেন, তিনি বাগরামে সেনা মোতায়েন করতে চান।

ট্রাম্পের দাবি, বাগরাম চীনের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ভি সাইটের খুব কাছে অবস্থিত, তাই এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা জরুরি ছিল। তিনি এমনও বলছেন যে, বর্তমানে বাগরাম নাকি চীনের দখলে। যদিও এই চীনা উপস্থিতির ব্যাপারে এখনো কোনো নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি, তবে বাগরামের কৌশলগত গুরুত্ব মার্কিনীদের কাছে ব্যাপক।

বাগরামের দুটি বড় রানওয়ে এবং প্রায় ১০০টি সামরিক বিমান পার্কিং করার জায়গা রয়েছে। এই বিমান ঘাঁটি শুধু চীনের জন্যই নয়, ট্রাম্পের ইরান নীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বাগরামে আমেরিকার উপস্থিতি বেইজিং ও তেহরানকে স্পষ্ট বার্তা দেবে। ট্রাম্প সম্ভবত এক ঢিলে দুটি পাখি মারতে চান। সেই ঢিলের নাম বাগরাম।

প্রশ্ন হলো, তালেবানরা কেন খাল কেটে কুমির আনবে? তারাই তো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছে আমেরিকান সৈন্যদেরকে তাড়ানোর জন্য। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, নিরাপত্তা। তালেবানের অনেক শত্রু রয়েছে, যেমন খোরাসান প্রদেশের আইএস জঙ্গিরা। তালেবানরা আইএস-কে তাদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখে।

এছাড়াও রয়েছে পাকিস্তান। সম্প্রতি তালেবান এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। বারগামে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি মানে আইএস এর বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা এবং নজরদারি বৃদ্ধি। এটি পাকিস্তানকে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য করবে, যা তালেবানের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ হলো অর্থ। তালেবান বর্তমানে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকাকে বাগরামে ফেরা মানে হলো ডলারের আগমন। সেই লেনদেনও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। গত মাসে তালেবানরা একজন আমেরিকান নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে। এই নিয়ে এ বছর মোট চারজন আমেরিকানকে মুক্তি দেওয়া হলো। বিনিময়ে আমেরিকা বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তালেবান নেতার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, যার মধ্যে সিরাজউদ্দিন হাক্কানিও রয়েছেন, যিনি একসময় মার্কিন সেনাদের উপর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এবং এফবিআই-এর মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন।

এটি মার্কিন নীতির একটি বড় পরিবর্তন। শুধু তাই নয়, আমেরিকা আফগানিস্তানে তাদের কনস্যুলার পরিষেবা পুনরায় শুরু করতে চাইছে। কূটনৈতিক আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তালেবানও এটিকে স্বাগত জানাচ্ছে। সম্প্রতি আফগানিস্তান ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বন্দীদের মুক্তি এবং আমেরিকায় বসবাসকারী আফগানদের কনস্যুলার পরিষেবা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপর জোর দিয়েছেন।

তাহলে এরপর কী? আমেরিকা কি সত্যিই বাগরামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে? আপাতত এটা শুধু খবর। তবে ট্রাম্প যদি কোনো চুক্তি করেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটি কৌশলগত মাস্টারস্ট্রোক হবে নাকি আরেকটি বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা সময়ই বলবে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, বাগরামের গল্প এখনো শেষ হয়নি। মার্কিনীদের আনাগোনা সেখানে বেড়ে যাবার পর নিত্য নতুন গল্প শোনাবে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো।

Reendex

Must see news