বিশ্বজুড়ে যখন নানা মেরুকরণ চলছে, তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নজর পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া এখন মস্কোর আগ্রহের কেন্দ্রে। রাশিয়ার সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ এই অঞ্চলে নতুন কৌশলগত কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি তিনটি রুশ যুদ্ধজাহাজ নীরবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছে। যদিও একে উভয় পক্ষই বলছে একটি শুভেচ্ছা সফর এবং রুটিন বিরতি, কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর পেছনে আরও গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে।
কেননা, এই সফরের ঠিক আগেই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মস্কো সফর করেন, যেখানে রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার বৈঠক হয়। আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল অস্ত্র ক্রয় এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।

বাংলাদেশ ও রাশিয়ার রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে প্রবেশে বাধা দিয়েছিল সোভিয়েত নৌবাহিনী, যা বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশ অস্ত্র ও উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা রাশিয়ার অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে এবং এবছরই এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা।
সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রতি মস্কোর গভীর কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে এবং এটা সহজেই অনুমেয় যে ভারত মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অন্যতম সহযোগী মনে করে শক্তিধর দেশটি।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে- রাশিয়া ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বিয়াক দ্বীপে একটি বিমান ঘাঁটি তৈরির জন্য আগ্রহী। এই দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র অস্ট্রেলিয়া থেকে মাত্র ১,৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
যদি সত্যিই সেখানে রাশিয়া বিমান ঘাঁটি স্থাপন করে, তবে তা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে, রাশিয়া সেখানে দূরপাল্লার বোমারু বিমান মোতায়েন করতে চায়।

এই খবরের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ এই জল্পনাকে উস্কে দিয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো মস্কো সফর করেন। এরপরই ইন্দোনেশিয়া ব্রিকস জোটে যোগ দেয়, যে সিদ্ধান্তে রাশিয়ার প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়।
তাছাড়া, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সের্গেই শোইগু জাকার্তা সফর করেন এবং বাণিজ্য, পর্যটনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করেন – যার মধ্যে সামরিক বিষয়াদিও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী জুনে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও এবং পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হতে পারে, যেখানে বিমান ঘাঁটির বিষয়ে আলোচনা হলেও হতে পারে।
যদিও ইন্দোনেশিয়া সরকার এই রিপোর্টগুলোকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে, তবে অস্ট্রেলিয়া বেশ উদ্বিগ্ন। তারা জানিয়েছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে এবং এই অঞ্চলে তারা রাশিয়ার প্রভাব দেখতে চায় না।
ইন্দোনেশিয়া প্রায় ১৭,০০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি বিশাল দেশ এবং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ মালাক্কা প্রণালীর পাশে এর অবস্থান। তাই এর কৌশলগত গুরুত্ব অনুধাবন করে রাশিয়া তাদের পৰিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ইউরোপ থেকে ইন্দো প্যাসিফিকে কেন রাশিয়া?
ইউরোপে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও, পুতিন ইন্দো-প্যাসিফিক এবং গ্লোবাল সাউথে নিজের প্রভাব বাড়াতে তৎপর। সুদানে নৌ ঘাঁটি স্থাপন, পশ্চিম আফ্রিকায় রুশ সেনা মোতায়েন, এসব তারই ইঙ্গিত।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এখন এক কৌশলগত দাবার ছক। একদিকে চীন দক্ষিণ চীন সাগরকে সামরিকীকরণ করছে, অন্যদিকে আমেরিকা তার মিত্রদের নিয়ে জোট গঠন করছে। এর মধ্যেই নিজেদের আধিপত্য জোরদারে রাশিয়া সাজাচ্ছে তাদের নিজস্ব পরকিল্পনা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী এবং সামরিক সম্পদের যোগানের উপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করা কি মস্কোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াবে? নাকি এটি পুতিনের সুদূরপ্রসারী কৌশলেরই অংশ? সব প্রশ্ন আর সমীকরণের উত্তর মিলবে সময়মত।