সময়ের জনমাধ্যম

হাইড্রোজেন প্রযুক্তি ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

জলবায়ু সম্মেলনের সফলতা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেক দেশই নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। পেট্রোলিয়াম এর ব্যবহার কমিয়ে তারা ঝুঁকছে সৌর, বায়ু ব্যবহারের দিকে। সজীব সেন লিখেছেন আগামী দিনের জ্বালানি প্রযুক্তি নিয়ে!

হাইড্রোজেন প্রযুক্তিঃ
বর্তমানে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ফসিল ফুয়েল বা হাইড্র-কার্বনের উপর নির্ভিরশীল। তেল বা গ্যাসের দাম একটু এদিক সেদিক হলেই আমাদের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। মাঠের ফসল বা কারখানার পণ্য উৎপাদনের পর সেটা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে, পণ্যের সাথে যোগ হয় পরিবহন খরচ, জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, ফলে পণ্যের দামও বাড়ে। তাই জ্বালানি মূল্যের সাথে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু প্রাকৃতিক তেল গ্যাস ব্যবহারে পরিবেশের ওপর তার বিরূপ প্রভাব ভবিষ্যতের পৃথিবীকে অনিরাপদ করছে। বর্তমান বিশ্ব তাই জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে তেল-গ্যাস বা কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসতে চায়। সেক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প কী?

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হাইড্রো কার্বন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, কিন্তু শুধু হাইড্রজেন ক্ষতিকর না এবং এই হাইড্রজেন হাইড্রো কার্বনের বিকল্প হিসাবে বেশ ভালভাবে কাজ করে। শুধু তাই নাই না, হাইড্রজেন আরো একটা কঠিন সম্যসার সমাধান দেয়, এটা ভালো এনার্জি স্টোরেজ হিসাবে কাজ করে।

হাইড্রোজেন প্রযুক্তি আসলে কীঃ
যেমনটা আমরা ছোটবেলার বইয়ে পড়েছি, জলের ভেতরে ডিরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি বিদ্যুতের দুইটি তার এনোড আর ক্যাথোড হিসাবে দিলেই হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন তৈরি হয়। সহজ ভাষায় এটাই হাইড্রোজেন প্রযুক্তি। যদিও জার্মানি কিছু প্রযুক্তিগত উন্নতি করে বেশি কার্যকরী ইলেক্টোলাইজার তৈরি করেছে, কিন্তু মূল প্রযুক্তি সেই এনোড আর ক্যাথোডই। আবার হাইড্রোজেন ফুয়েলসেল বাতাসের অক্সিজেন মিলিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি আর জল তৈরি করতে পারে। তাই বলা যায় এটা বেশ সহজ প্রযুক্তি।

হাইড্রোজেন প্রযুক্তি কেন প্রয়োজন?
এটা এখন স্বীকৃত যে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে রক্ষা পেতে আমাদের শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমস্যা হল এটা সব সময় চাহিদামত পাওয়া যায় না, যখন বেশি দরকার তখনই বরং পাওয়া যায় না। যেমন দুপুরে সবচেয়ে বেশি সোলার এনার্জি পাওয়া গেলেও বিকেলে কমতে থাকে এবং সন্ধ্যায় সোলার থেকে কোনো এনার্জি পাওয়া যায় না, অথচ রাতে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। বায়ু বিদ্যুৎও বাতাসের গতির সাথে উঠানামা করে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এনার্জি স্টোরেজ বা ব্যাটারি ব্যাবহার করা হয়, কিন্তু ব্যাটারি বানানোর পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব না। আর একটা বড় শহর বা বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাসিলিটি সম্পূর্ণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে চালানোর জন্য যত বড় ব্যাটারি লাগবে তার ব্যাবস্থাপনা ও নিরাপত্তাও বেশ জটিল। সে ক্ষেত্রে বাড়তি নবায়নযোগ্য জ্বালানি যখন পাওয়া যায়, তা দিয়ে হাইড্রোজেন উৎপাদন করে, বেশি চাহিদার সময় হাইড্রোজেন থেকে আবারো ইলেক্ট্রিসিটি বানানো বেশ সহজ সমাধান।

পশ্চিমা বিশ্ব হাইড্রোজেন নিয়ে কী করছেঃ
গ্রিনহাউজ গ্যাস ইমিশন নেট জিরো করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব বেশ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে হাইড্রোকার্বনের ব্যবহার শুন্যে নামিয়ে আনতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান হাইড্রোকার্বন এর ব্যবহার কমাতে ইতোমধ্যে বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে চায় সর্বোচ্চ পরিমাণে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সদস্য দেশগুলাকে হাইড্রোজেন উৎপাদনের বাধ্যতামূলক লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। ২০৩০ সালের ভেতরে তাদের প্রতিবছর ২০ মিলিয়ন মেট্রিকটন সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে হবে। জাপান তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও নিজেদের নেট জিরো লক্ষ্য পূরণের জন্য হাইড্রোজেন উৎপাদনের বড় প্রকল্প নিয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের বছর প্রতি লক্ষ্যমাত্রা ২০ মিলিয়ন মেট্রিকটন সবুজ হাইড্রোজেন।

আমেরিকা ও বেশ বড় লক্ষ্য নিয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ মিলিয়ন মেট্রিকটন সবুজ হাইড্রোজেন। যদিও বর্তমানে তাদের উৎপাদন বলতে গেলে শুন্য। এছাড়া ব্রাজিল, ভারত, চিন, ও দক্ষিণ আফ্রিকারও হাইড্রজেন প্রকল্প আছে বলে জানা যায়।

হাইড্রোজেন প্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকুঃ
বর্তমান রাশিয়ান-ইউক্রেনিয়ান যুদ্ধ স্পষ্ট করে দেখিয়েছে যে জ্বালানির দাম বাড়ার সাথে সাথে আমাদের অর্থনীতি কী রকম চাপে পড়ে যায়। যদি জ্বালানির স্বয়ংসম্পূর্ণতা থাকে তাহলে আমাদের অর্থনীতি চাপমুক্তভাবে এগিয়ে যেতে পারে। সোলার এবং হাইড্রোজেন এর যৌথ প্রযুক্তি আমাদের কাঙ্ক্ষিত জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের কার্বন নির্গমন কমানোর যে নেট জিরো লক্ষ্য তা তারা নিজেরা হাইড্রোজেন উৎপাদন করে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণ সোলার এনার্জি সম্ভাবনা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা গেলে, বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজনের হাইড্রজেন উৎপাদন করে বাড়তি হাইড্রজেন এক্সপোর্ট করতে পারবে।

বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো যখন নেট জিরোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ভবিষ্যতে সারা বিশ্বের তেল ভিত্তিক জ্বালানী ব্যাবস্থা হাইড্রোজেন ভিত্তিক জ্বালানি ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তখন আমরা যদি পরিবর্তিত না হই তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। ছোট পরিসরে হলেও বাংলাদেশের উচিৎ হাইড্রোজেন প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া।