মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে। সুয়েদা প্রদেশে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী মোতায়েনে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছে সৌদি আরব—যা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ইসরায়েল। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সাম্প্রতিক এক আলোচনায় উত্তেজনা দেখা দেয়।
বিশ্ব কূটনীতিকদের মতে, সৌদি আরব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে নিজেদের সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দামেস্কের অধিকার, এবং এই বিষয়ে বাইরের কোনও দেশের হস্তক্ষেপ তারা মেনে নেবে না।
সম্প্রতি সুয়েদা প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্রুজ জনগোষ্ঠী ও সুন্নি বেদুইনদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই সহিংসতা ঠেকাতে সিরিয়ার সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে অঞ্চলটিতে সেনা মোতায়েন শুরু করে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় ইসরায়েল। ফলশ্রুতিতে তারা সিরিয়ার সেনাবহরে হামলা চালায়, এমনকি রাজধানী দামেস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশেপাশেও বোমা ফেলে।
ইসরায়েল সরাসরি সিরিয়াকে দক্ষিণাঞ্চলে সেনা না পাঠাতে হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে পদক্ষেপ নেয়দামেস্ক —যার জবাবে একের পর এক বিমান হামলা চালায় তেলআবিব।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ একাধিক আরব দেশ যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানায়—ইসরায়েলের এই হামলা ‘সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আঘাত” এবং “অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ’।
এই বিবৃতিতে আরব দেশগুলো সিরিয়ার ‘ঐক্য, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার’ প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র, যারা দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস-এর সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়েছে, এখন চাইছে এই বাহিনী সিরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আসুক। এই লক্ষ্যে দামেস্ক ও কুর্দিদের মধ্যে সমঝোতা গড়ার চেষ্টা করছে দেশটি।
কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বোমা হামলা সেই প্রচেষ্টায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, ওয়াশিংটন সম্প্রতি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, স্থিতিশীল সিরিয়ার ধারণা সামনে নিয়ে এসেছে —যার পথে ইসরায়েলের সামরিক হস্তক্ষেপ বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন আহমেদ আল-শারা, যিনি আগে আল-কায়েদার সিরীয় শাখা ও হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা ছিলেন। আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সিরিয়ার পুনর্গঠনে সরাসরি সহায়তা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশ শারাকে কেন্দ্র করে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে চায়। এমনকি মে মাসে রিয়াদে শারা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যেও সরাসরি বৈঠক হয়। বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচেটিয়া প্রভাব কমানো ও সিরিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কিন্তু সৌদি আরব ও তুরস্কসহ অনেক দেশের সমন্বিত কূটনৈতিক অবস্থান ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর স্পষ্ট অবস্থানকে আরো দৃঢ় করছে।
ট্রাম্প প্রশাসন এখনও ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি চূড়ান্ত স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির আশায় আছে, কিন্তু বাস্তবতা এখন অনেকটাই জটিল হয়ে উঠেছে।