অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দিশা হারিয়ে পথ খুঁজতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ঘাটতি কাটিয়ে বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্ত ফিরে এসেছে। নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই রিজার্ভ, রফতানি এবং রেমিট্যান্স এই তিনটি প্রধান সূচক একযোগে মৃদু ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখাচ্ছে। এর পাশাপাশি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সরকার সাফল্য পেয়েছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এলেও, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে: বিনিয়োগের খরা। দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনকভাবে কমে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য উদ্বেগের কারণ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিক লেনদেনে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা গেছে, যা আগের বছরের ঘাটতিকে অতিক্রম করেছে। চলতি হিসাবেও ১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত এসেছে। রেমিট্যান্স, বৈদেশিক সাহায্য এবং ডলারের বিনিময় হারের স্থিতিশীলতাকে এই সাফল্যের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে। যদিও আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, তবুও এই বৃদ্ধি ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
জুলাই মাসে রফতানি প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়া ও কৃষিপণ্যের রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪৮ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ এবং প্রণোদনা এই রেকর্ডের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। জুন মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সবকিছু যখন ইতিবাচক, তখন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি বেসরকারি বিনিয়োগের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ সুদের হার, ডলার সংকট এবং তারল্য ঘাটতির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে ধস নেমেছে।
চলতি বছরের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদহার এবং খেলাপি ঋণের চাপ এর প্রধান কারণ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ২৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে, যা নতুন বিনিয়োগ না হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৫.৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও গভীর হয়েছে, যা ঋণ বিতরণের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির এই গতি ধরে রাখতে হলে বিনিয়োগের বাধা দূর করা জরুরি। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, ‘নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে আগে রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।’ বিআইবিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী উচ্চ সুদের হারকে বিনিয়োগে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির গুরত্ব তুলে ধরে ড. মুস্তাফিজুর রহমান সতর্ক করে বলেছেন, ‘বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়াতে হবে। কেবল ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনৈতিক গতি টেকসই করতে পারবে না।’
অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, সুদের হার কমানো, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি।