সময়ের জনমাধ্যম

ভেজাল চক্রে বলির পাঁঠা শিশুরা

বাজারে বিক্রি হওয়া চিপস, ওয়েফার, চকোলেট, জুস ও কোমল পানীয়তে অতিমাত্রায় কার্বোহাইড্রেড ও মেলামিন থাকায় শিশুদের জন্য এগুলো ক্ষতিকর হলেও এসব খাবারের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও বিস্কুট, কেক কিংবা পাউরুটিসহ অন্যান্য কনফেকশনারি পণ্যেও ভেজাল মেশানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের সাথে প্লাস্টিক মিশিয়ে সেগুলোকে আরও বিষাক্ত করে ফেলা হচ্ছে। এসব খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের টার্গেট মূলত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। তাদের জন্যই শহর কিংবা গ্রামের দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত এসব খাবারের পসরা মেলে।

এছাড়াও বাজারে বিদেশ থেকে আমদানি করা যেসব বেবি ফুড রয়েছে তার অধিকাংশতেই মাত্রাতিরিক্ত সুগার বা শর্করা আছে বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন এ ধরনের খাবার খেলে শিশুর দাঁতের গঠনের উপর প্রভাব পড়তে পারে। পরবর্তীতে মিষ্টি খাবারের প্রতি শিশুদের আসক্তি তৈরি হতে পারে।

ওয়ার্ল্ড হেল্‌থ অর্গানাইজেশনের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি ইউরোপেও তিন বছরের থেকে কম বয়সী শিশুদের জন্য যেসব বেবি ফুড বিক্রি করা হয় তাতে শর্করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এত কম বয়সে অতিরিক্ত পরিমাণে শর্করা শরীর গ্রহণ করায় শিশুদের মধ্যে স্থূলতার প্রবণতাও বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।

জাতিসংঘ রেডিওর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবার খেয়ে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে পাঁচ বছরেরও কম বয়সী।

এদিকে, এসব শিশু খাদ্যের একটা বড় অংশ লাগেজের মাধ্যমে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে আনে একটি চক্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব পণ্য মেয়াদ উত্তীর্ণের কাছাকাছি সময়ে থাকে। সেসব পণ্য ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশের মার্কেটগুলোতে। এসব ফুড শিশুদের জন্য আরো একটি বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অভিযানে এসব পণ্য আটক হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ শিশুরা স্থূলতা ও ‍উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, এর প্রধান কারণ শিশুদের এসব বাইরের খাবার খাওয়া। স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

বাংলাদেশের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষণা বলছে, এখন পেটের পীড়ার প্রচুর শিশু রোগী পাওয়া যায়। যারা সরাসরি ভেজাল খাদ্যের জন্য আক্রান্ত হয়। এর বাইরেও ভেজাল খাবার শিশুদের নানাভাবে ক্ষতি করে থাকে। খাবারে ক্ষতিকারক রঙ ও রাসায়নিকের ব্যবহারের কারণে শিশুর কিডনি ও লিভারসহ শরীরের যেসব অংশে বেশি রক্ত চলাচল করে সেগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এর বাইরে পেটের বিভিন্ন পীড়া, আলসার, চর্মরোগসহ নানা রকম রোগ ইদানিং ব্যাপকহারে দেখা যাচ্ছে।

অথচ এসবের পরোয়া না করে মাত্রাতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেড ও মেলামিন সমৃদ্ধ  চিপস, চকোলেট ও ওয়েফারসহ নানা রকম শিশুখাদ্যে এখন বাজার সয়লাব। দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো থাকে এসব শিশুখাদ্যের আকর্ষণীয় প্যাকেট, দামটাও হাতের নাগালে। আর প্যাকেটের সাথে বিনামূল্যে দেয়া খেলনার প্রলোভনও শিশুদের এসব খাবারের প্রতি আকৃষ্ট করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এসব নকল ও ভেজাল খাদ্য শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকার রামপুরা এলাকার একটি বাড়ির কেয়ারটেকার, চল্লিশোর্ধ্ব মাইনুল ইসলাম মুহূর্ত নিউজকে জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে স্বপরিবারে ঢাকায় থাকছেন তিনি। তার দুই সন্তানের বয়স তিন ও দেড় বছর। তিনি জানান, তার এই দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন প্রায় খরচ হয় ১০০ টাকা, যার প্রায় পুরোটাই বাজারের চিপস, জুস, চকোলেট জাতীয় খাবারের পেছনে ব্যয় হয়ে থাকে।

ওই এলাকার আরেক অভিভাবক বেসরকারি চাকুরীজীবী রাকিব হাসান জানান, বাড়িতে তৈরি করা খাবারের চেয়ে বাইরের খাবারের প্রতি বাচ্চাদের ঝোঁক বেশি। কারণ হিসেবে বলেন, কোম্পানিগুলো বাচ্চাদেরকে তাদের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে সাথে বিভিন্ন খেলনা জুড়ে দিয়ে ও চটকদার রঙিন মোড়কে এসব পণ্য বাজারজাত করছে। তাই মানহীন জেনেও সন্তানের জেদে পড়ে অগত্যা সেসব খাবারই কিনে দিতে হচ্ছে।

বিএসটিআই এর অনুমোদনহীন এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন বড়বড় শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে গুদামজাত করেন। পরে বিভিন্ন কৌশলে নানান লোভনীয় অফারে জেলা-উপজেলার হাট-বাজারে অল্পমূল্যে সেগুলো বিক্রি করে থাকেন।

রাজধানীর বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোনও কোনও ব্যবসায়ী নামী-দামী দুই-একটি কোম্পানির ডিলারশিপ গ্রহণ করে তার আড়ালে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য প্রত্যন্ত এলাকার হাট-বাজারে পৌঁছে দিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক দেশে উৎপাদিত শিশুখাদ্যগুলো আরও ভয়াবহ। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন শিশুখাদ্যের অসংখ্য নকল ও ভেজাল কারখানা। যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে শিশুখাদ্য। আসল আর নকল পণ্যের গায়ে একই লেবেল, তাই এগুলো চেনাও কঠিন। আসল পণ্যের পাশাপাশি এসব ভেজাল খাদ্য ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। এতে শিশুদের পছন্দের খাবার কিনতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা আর দুশ্চিন্তায় ভুগছেন অভিভাবকরা।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় কর্মজীবী নারী তাহমিনা হকের সাথে। তিনি জানান, সচরাচর নকল এড়াতে বাজারের বড় দোকান কিংবা সুপারশপ থেকে বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনেন। কিন্তু কিছুদিন আগে সন্তানের জন্য বড় দোকান থেকে কেনা একটি জুসের প্যাকেটকে নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে তার মনে। বলেন, প্যাকেটের গায়ে মেয়াদ থাকলেও পণ্যটিতে দুর্গন্ধ পেয়ে সেটি খেতে পারেনি তার সন্তান। এরপর থেকে বড় দোকান কিংবা সুপারশপেও আস্থা নেই তার। ঘটনার পর থেকে পণ্য কিনতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন তিনি। জানান, খেতে হবে, বাঁচতে হবে, তাই কিনতে হয়। এর থেকে বেশি আর কিছু করার নেই গ্রাহকদের।

বেসরকারি সংস্থা কেয়ারে কর্মরত এই কর্মজীবী মা আরও জানান, ‘একটি কিনলে আরেকটি ফ্রি’ অফারের নামে ইদানিং সুপারশপগুলো তাদের প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যগুলো বিক্রি করছে। এর মধ্যে একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিশুখাদ্য। নিজেও দুয়েকবার এসব পণ্য কিনেছেন বলে জানান তিনি। কিন্তু পরে দেখেন ক্রয়কৃত পণ্য এবং ফ্রিতে পাওয়া পণ্য দুটোই মেয়াদ উত্তীর্ণের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, কাপ্তান বাজার, সাভার, টঙ্গী, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শতশত ভেজাল কারখানা। চকবাজার থানার কামালবাগ এলাকায় সুভেল লজেন্স ফ্যাক্টরি, শহীদ ফুড ফ্যাক্টরি, কবির ফুড ফ্যাক্টরি ও আবির ফুড ফ্যাক্টরিসহ বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব ফ্যাক্টরিতে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহার করে শিশুখাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে।

বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিএসটিআই এর অভিযানে বেরিয়ে এসেছে শিশুখাদ্যে প্রতারণার আরও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইদানিং শিশুদের খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, নিষিদ্ধ কেমিক্যাল, মোম ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুস এবং জেলিসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য। এসব পণ্যের প্রধান টার্গেট শিশুরা। এগুলো খাওয়ার কারণে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।

বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল হক মুহূর্ত নিউজকে বলেন, ‘রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ সারাদেশের বাজারগুলোতে প্রায় অর্ধশতাধিক অননুমোদিত ও নিন্মমানের শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। শিশুখাদ্যসহ সকল পণ্যের নকল ও ভেজালরোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অনিয়ম বুঝে অর্থদণ্ড এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে।’

তিনি আরও জানান, দেশে নিম্নমানের পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে অবৈধ পথে শিশুখাদ্য দেশে আনে। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বিমান বালারাও উল্লেখযোগ্য হারে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ ধরনের শিশুখাদ্য বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে নিম্নমানের শিশুখাদ্য আমদানির মাধ্যমে বাজারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা বিষয়গুলি সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছি এবং ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার মুহূর্ত নিউজকে বলেন, বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুখাদ্যের মান কতটুকু ভালো, তা বোঝা মুশকিল। তাই আমরা ইতোমধ্যেই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শিশুখাদ্যে ভেজালরোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেছি। এজন্য সেল গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সেলের সদস্যরা শিশুখাদ্যের বিভিন্ন দিক ক্ষতিয়ে দেখছে। এছাড়া শিশুখাদ্য তৈরির কারখানাগুলোতেও অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। কোনও ধরনের অনিয়ম পেলে সাথে সাথে ভোক্তা আইনের আওতায় কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে দোকান-কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে। পাঠানো হচ্ছে জেলে।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, নিম্নমানের মুখরোচক ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের শরীরে এসব উপাদান স্লো পয়জনিংয়ের মতো কাজ করছে। এসব মানহীন খাবার শিশুদের পেটে গেলে কিডনি ও লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাজারে থাকা শিশুখাদ্যের নাজুক অবস্থা এক কথায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি বলেন, ‘শিশুখাদ্য পরীক্ষাগারে পরীক্ষা না করে বাজারে উন্মুক্ত করা যায় না। পরীক্ষাহীন এসব পণ্যে ফ্যাট, টিস্যু, চিনি, প্রোটিন প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি থাকলে তা শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে, যার ফলাফল ভয়াবহ। এছাড়া দেশে মানহীন পরিবেশে শিশুদের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর রঙ ও রাসায়নিক মিশিয়ে অনেক রকম খাবার বাজারজাত করা হচ্ছে, এর প্রতি শিশুরা আকৃষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এসব মানহীন খাবার শিশুদের পেটে গেলে কিডনি ও লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।’

ভেজালের কারণে খাদ্য ও চিকিৎসার সাথে অন্য সব মৌলিক চাহিদাও কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। চিকিৎসক ও গবেষকদের ভাষ্যমতে, অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ভেজাল খাদ্য। তাই শিশুদের নিরাপদে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছেন সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।