সময়ের জনমাধ্যম

ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষদের দিয়ে ইসরায়েলের ‘বিভৎস কার্যকলাপ’

ইসরায়েলি সেনাদের মুখে শোনা ‘একটি মশা আনো’ এই আপাত নিরীহ বাক্যটি গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধে এক ভয়াবহ কোডনেম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। এপি’র প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই বাক্যটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

অভিযোগের গভীরে: নিরপরাধ প্রাণ নিয়ে সামরিক অভিযান

এপি’র প্রতিবেদনটি ইসরায়েলি বাহিনীর দুই সদস্য এবং একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, ‘একটি মশা আনো’ নির্দেশটি পেলে সেনারা একজন ফিলিস্তিনিকে ধরে আনত এবং তাকে সামরিক অভিযানের অগ্রভাগে পাঠাতো। এর উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার: নিজেদের সৈন্যদের সুরক্ষার জন্য নিরপরাধ বেসামরিকদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া। এর ফলে, হামাসের সম্ভাব্য হামলা বা পুঁতে রাখা বিস্ফোরক থাকলে, তা প্রথমে ওই ফিলিস্তিনি বন্দির উপরেই আঘাত হানতো।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, বেসামরিক নাগরিকদের কোনো সামরিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা ও পশ্চিমতীরে দীর্ঘদিন ধরেই এই কৌশল অবলম্বন করছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে এই পদ্ধতির ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক সেনা সদস্য জানান, গাজায় নয় মাস দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিজে এই মানবঢাল কৌশল বহুবার ব্যবহৃত হতে দেখেছেন। তার মতে, সেনাবাহিনীর রেডিও বার্তায় ‘একটি মশা আনো’ বলা হলে সেনারা বুঝে যেত রাস্তা থেকে একজন ফিলিস্তিনিকে ধরে এনে সামরিক কাজে ব্যবহার ব্যবহার করতে হবে।

এপিকে দেওয়া আরেক ইসরায়েলি সেনার সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ ঘটনা। একবার একটি ইসরায়েলি ইউনিট এক ফিলিস্তিনিকে ধরে এনে একটি বাড়িতে প্রবেশ করায়, যেখানে আরেকটি ইসরায়েলি ইউনিট অবস্থান করছিল। ভুলবশত তারা তাকে হামাসের যোদ্ধা মনে করে গুলি করে হত্যা করে। এরপর নাকি একজন সেনা কর্মকর্তা পরামর্শ দেন, ভবিষ্যতে যাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তাদের ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পোশাক পরিয়ে দেওয়া উচিত।

এই অভিযোগগুলো আরও গুরুতর আকার ধারণ করে যখন সাক্ষাৎকারদাতারা দাবি করেন যে, ইসরায়েলি বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও এই কৌশলের ব্যাপারে অবগত ছিলেন। ২০২৪ সালের এক বৈঠকে একজন ব্রিগেড কমান্ডার স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনিদের রাস্তা থেকে ধরে এনে অভিযানে ব্যবহারের নির্দেশ দেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

আইডিএফ’র প্রতিক্রিয়া এবং অবমাননাকর সম্বোধন:

এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এই অভিযোগ সম্পর্কে জানার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে যে, বেসামরিকদের জোরপূর্বক সামরিক অভিযানে যুক্ত করার বিষয়টি আইনি বাধার মধ্যে পড়ে এবং এসব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। তবে, আইডিএফ জানিয়েছে, এই তদন্তের বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে না।

প্রতিবেদনে আরও একটি উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে: ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের প্রায়শই ‘মশা’, ‘ভিমরুল’ ইত্যাদি অপমানজনক নামে ডাকে, যা তাদের প্রতি বিদ্বেষ ও অবমাননার এক চরম বহিঃপ্রকাশ।

‘একটি মশা আনো’ এই বাক্যটি এখন শুধু একটি সামরিক নির্দেশ নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক প্রতীক এবং গাজার যুদ্ধের ভয়াবহ মানবিক সংকটের একটি করুণ দৃষ্টান্ত। এই অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।