ইরানের পাল্টা সামরিক হামলা, গাজায় গণহত্যা অভিযানের চলমান ধারা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, এই ত্রিমুখী সংকটের মুখে ইসরায়েল আজ এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন দেশ ত্যাগ করাও হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রিত ও প্রায় অসম্ভব।
নতুন সরকারি সিদ্ধান্ত: দেশত্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা এক নতুন প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যার আওতায় দেশ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ইসরায়েলি নাগরিকদের অনুমোদন কমিটির অনুমতি নিতে হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু হওয়ার পরেও সরকার একটি স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে দেশত্যাগের মানদণ্ড নির্ধারণ করবে।’ ইতোমধ্যে, বেশ কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরায়েলি নাগরিকদের টিকিট বিক্রি করতে পারবে না, কারণ সরকার তাদের তা করতে নিষেধ করেছে।

‘এস্কেপ ফ্লোটিলা’ ও পালানোর মরিয়া চেষ্টা
তবে এতকিছুর পরেও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেমে নেই। বিপুলসংখ্যক ইসরায়েলি নৌকা ও ইয়াট ব্যবহার করে সাইপ্রাসের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রচেষ্টাকে ‘এস্কেপ ফ্লোটিলা’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ৭ লক্ষ আমেরিকান ও ৫ লক্ষ ইউরোপীয় দ্বৈত-নাগরিক বর্তমানে ইসরায়েলে অবস্থান করছেন। তাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে মরিয়া। শুধু ২০ জুন একদিনেই, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রায় ১০,০০০ মানুষের দেশত্যাগের অনুরোধ পেয়েছে।
বিদেশি উদ্ধার অভিযান ও চাপে দূতাবাসগুলো
কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে বিশেষ ফ্লাইট এবং বাসের ব্যবস্থা করেছে। কানাডা জানিয়েছে, ইসরায়েলে ৬,০০০ কানাডিয়ান নাগরিক নিবন্ধন করেছেন, এবং ৪০০ জন পশ্চিম তীর থেকে পালাতে চেয়েছেন। মিশর এবং জর্ডানের সীমান্ত দিয়ে অনেক আমেরিকান ও জার্মান নাগরিক ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন। ইউকে’র দূতাবাসেও দেশত্যাগের অনুরোধ বেড়েছে।
ইসরায়েলি সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ
‘মুভমেন্ট ফর কোয়ালিটি গভর্নমেন্ট ইন ইসরায়েল’ সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ইসরায়েলের ‘‘বেসিক ল’’ বা মৌলিক আইনের লঙ্ঘন। এছাড়া, অনুমতি প্রদানে ‘‘ব্যতিক্রমী কমিটির’’ নীতিমালাও অস্পষ্ট।

পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা পুরনো
এই দেশত্যাগের প্রবণতা নতুন নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৭,২০,০০০ ইসরায়েলি নাগরিক দেশ ত্যাগ করে আর ফেরেননি। ২০০৩ সালেই ইসরায়েলি সরকার স্বীকার করে, বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রায় ৭,৫০,০০০ ইসরায়েলি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
২০২২ সালে বার্তা সংস্থা মারিভ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ‘লিভিং দ্যা কান্ট্রি টুগেদার’ নামে একটি সংগঠন ১০,০০০ ইসরায়েলিকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরের পরিকল্পনার কথা জানায়। সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা মোরদেখাই কাহানা বলেন, “ইসরায়েলি পেশাজীবীরা যেন সহজে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারে, এজন্য মার্কিন সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
২০১১ সালে ইসরায়েলি সরকার একটি প্রচারণা চালিয়েছিল, যাতে দেশত্যাগী ইসরায়েলিদের ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়। তবে সেই প্রচারণা আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়, কারণ এতে মার্কিন সমাজকে ‘ইহুদিদের জন্য অনুপযুক্ত’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল।
জনসংখ্যা সংকট ও রাজনৈতিক উদ্বেগ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চলমান দেশত্যাগ ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ জনসংখ্যা ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করছে। দেশটির শীর্ষ জনসংখ্যাবিদ সের্জিও ডেলা পেরগোলা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, ‘যদি গণহারে ইহুদি নাগরিক ইসরায়েল ছাড়ে এবং আরবদের সংখ্যা বাড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ইহুদি পরিচয় টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।’ অর্থাৎ, জনসংখ্যাগত চাপ এবং রাজনৈতিক বৈধতা রক্ষার প্রশ্ন এখন ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে গাজা: গৃহচ্যুতির মুখেও ফিরতে চায় মানুষ
গাজার ২০ মাসের অবরোধ, খাদ্য সংকট, মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যার মাঝেও ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূমিতে থাকার এবং ফিরে যাওয়ার সংকল্পে অটল। হারেৎজ এক রিপোর্টে বলেছে, “যেখানে ইসরায়েলিরা দেশ ছাড়তে মরিয়া, সেখানে গাজাবাসী ফিরে যেতে চায়।’ এক তরুণ ইসরায়েলি বলেন, “যুদ্ধ হলো দ্বিমুখী ছুরি,আমরা গাজাবাসীদের মতো ধ্বংসের মুখে না পড়লেও, জীবন এখানে আর স্বাভাবিক নয়।”

কয়েক দশক আগে ইসরায়েল দাবি করত, ‘লেট মাই পিপল গো’ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে আনতে। আজ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বহু ইসরায়েলি এখন বলছে, ‘নেতানিয়াহু, আমাদের যেতে দাও।’
ইসরায়েলি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্র ও জনসংখ্যাগত ভারসাম্য এখন চরম প্রশ্নের মুখে। আর সেই প্রশ্নের মুখোমুখি জনগণ নিজেরাই দেশ ছাড়ার কথা ভাবছে, এই বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।