ডলারের দুর্বলতা কি টাকার স্থিতিশীলতার নেপথ্য কারণ?


১. ভূমিকা: টাকার সাম্প্রতিক স্থিতিশীলতা ও প্রচলিত ধারণা
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার স্থিতিশীলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে এর মূল্য বৃদ্ধি জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও অর্থনীতিবিদদের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। এই ইতিবাচক প্রবণতার পেছনে সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচক্ষণ আর্থিক ব্যবস্থাপনা, দেশের শক্তিশালী রপ্তানি আয় এবং ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নিঃসন্দেহে, এই অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিগুলো টাকার বর্তমান অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, এই প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে একটি গভীরতর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই আলোচনায় আমরা দেখব, টাকার স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষত মার্কিন ডলারের নিজস্ব গতিপথ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতি ও বিশাল জাতীয় ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশল কীভাবে পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই দিকটি প্রায়শই আলোচনায় আসে না, অথচ এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। টাকার স্থিতিশীলতাকে কেবল অভ্যন্তরীণ কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্পূর্ণ; বৈশ্বিক কারণ, বিশেষত মার্কিন ডলারের গতিবিধি, একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
২. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি: রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও মুদ্রানীতির ভূমিকা
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রবণতা প্রদর্শন করছে, যা টাকার স্থিতিশীলতায় সরাসরি অবদান রাখছে।
রপ্তানি খাতের শক্তিশালী পারফরম্যান্স
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ৪,৮২৮.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা পূর্ববর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের ৪৪,৪৬৯.৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় ৮.৫৮% বেশি 1। যদিও ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এই অর্জন ৩.৪৩% পিছিয়ে ছিল, পোশাক শিল্প (রেডি-মেড গার্মেন্টস) একাই ৩৯.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে 1। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়ে টাকার উপর অবমূল্যায়নের চাপ কমাতে সরাসরি অবদান রাখছে। পোশাক শিল্পের আধিপত্য বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের স্থিতিশীলতার একটি মূল ভিত্তি, যা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড বৃদ্ধি
২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ২১শে জুন পর্যন্ত, প্রবাসীরা রেকর্ড ২৯.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৭% বা ৬.২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি 3। বিশেষত, মার্চ ২০২৫-এ রেকর্ড ৩.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত বছরের মার্চের তুলনায় ৬৪.৭% বৃদ্ধি 4। এই শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের BPM6 পদ্ধতি অনুযায়ী নিট রিজার্ভ ২০.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) 4। রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফন কেবল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে না, এটি আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি প্রবাসীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং হুন্ডি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের কার্যকারিতাও নির্দেশ করে। এই বৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রেখেছে। তারা নীতি সুদহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং সরকারি ব্যয়ের জন্য নতুন উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ জারি করা থেকে বিরত রয়েছে 5। বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে এবং আরও নমনীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ৮ মে ২০২৪ তারিখে একটি ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালু করে। এই সিস্টেমের মধ্য-হার ১১৭.০০ টাকা প্রতি মার্কিন ডলারে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে 5। ক্রলিং পেগ সিস্টেম টাকার অবমূল্যায়নের চাপ কমাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রাথমিক সাফল্য দেখিয়েছে। এটি বাজারের শক্তিকে আরও বেশি প্রভাব ফেলার সুযোগ দিয়ে কাঠামোকে সরল করেছে, যা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতায় সরাসরি অবদান রাখছে।
নিম্নোক্ত সারণিটি বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে:
সারণি ১: বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ (জুলাই-জুন)
অর্থবছর | রপ্তানি আয় (মিলিয়ন মার্কিন ডলার) | পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় % পরিবর্তন | রেমিট্যান্স প্রবাহ (মিলিয়ন মার্কিন ডলার) | পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় % পরিবর্তন |
২০২৩-২৪ | ৪৪,৪৬৯.৭৪ 1 | – | ২৩,২৯০.০০ (আনুমানিক) 3 | – |
২০২৪-২৫ | ৪৮,২৮৩.৯৩ 1 | +৮.৫৮% | ২৯,৫০০.০০ 3 | +২৬.৭% |
এই সারণিটি পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি প্রধান স্তম্ভের তুলনামূলক চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি কেবল সংখ্যাগত তথ্য নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে এই খাতগুলোর প্রবৃদ্ধির প্রবণতাও দেখায়, যা টাকার স্থিতিশীলতায় তাদের অবদানকে আরও সুস্পষ্ট করে।
৩. মার্কিন ডলারের দুর্বলতা: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ নীতি
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক শক্তির পাশাপাশি, মার্কিন ডলারের সাম্প্রতিক দুর্বলতাও টাকার স্থিতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ডলার সূচকের সাম্প্রতিক পতন
মার্কিন ডলার সূচক, যা প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান পরিমাপ করে, গত ছয় মাসে ১০% এর বেশি কমেছে। এটি ১৯৭৩ সালের পর থেকে প্রথম ছয় মাসের সবচেয়ে বড় পতন এবং একটি রাষ্ট্রপতি মেয়াদের সবচেয়ে খারাপ শুরু 6। যদিও ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ট্রেড-ওয়েটেড ডলার ৯.০% শক্তিশালী হয়েছিল 9, এরপর থেকে এর মান কমেছে, যা ২০২৫ সালের প্রথম দিকে ডলারের দুর্বলতার প্রবণতাকে নির্দেশ করে 6। ডলারের এই সাম্প্রতিক এবং উল্লেখযোগ্য পতন একটি বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ, যা কেবল মার্কিন অভ্যন্তরীণ নীতি নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়। এই সময়গত পরিবর্তন ডলারের গতিপথের জটিলতা এবং এর সাম্প্রতিক পরিবর্তনকে তুলে ধরে।
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের মুদ্রানীতি ও সুদের হার
জুন ২০২৫-এর বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) সুদের হার ৪.২৫% থেকে ৪.৫০% এর মধ্যে অপরিবর্তিত রেখেছে 10। ফেডের হালনাগাদ করা পূর্বাভাসে ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে, যেখানে মূল্যস্ফীতি এবং বেকারত্বের প্রত্যাশা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ২০২৫ সালে দুটি সুদের হার কমানোর পূর্বাভাস দিচ্ছে 10। ফেড চেয়ারম্যান বারবার জোর দিয়েছেন যে ফেড তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে “ডেটা-নির্ভর” এবং ২% দীর্ঘমেয়াদী মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায় 11। ফেড সরাসরি ডলারকে দুর্বল করার নীতি গ্রহণ না করলেও, সুদের হার কমানোর বাজারের প্রত্যাশা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুর্বল পূর্বাভাস ডলারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে, যা এর অবমূল্যায়নে অবদান রাখে 6। ফেডের “ধীরস্থির” নীতি ডলারের দুর্বলতাকে উৎসাহিত করার একটি পরোক্ষ কারণ হতে পারে, কারণ এটি ডলার-ভিত্তিক সম্পদের আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। এর উপরে যোগ হয় ট্রাম্পের শুল্ক সংশ্লিষ্ট অস্থিরতা।
বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতি ও ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা
উচ্চ শুল্ক, ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ ডলারের পতনে অবদান রেখেছে 6। সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতি মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে অবস্থানকে দুর্বল করছে এবং ডি-ডলারাইজেশন প্রচেষ্টা গতি পাচ্ছে 8। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ইউরো ও স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে 8। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বাধা এবং ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে, যা ডলারের দুর্বলতার একটি বহিরাগত কারণ 11। ঐতিহ্যগতভাবে ডলার একটি নিরাপদ আশ্রয় হলেও, এখন ইউরো বা স্বর্ণের মতো বিকল্পের দিকে ঝুঁকছে 8, যা ডলারের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং এর বৈশ্বিক আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৪. মার্কিন জাতীয় ঋণ ও ডলারের অবমূল্যায়ন কৌশল: একটি “হিডেন” দিক
মার্কিন ডলারের দুর্বলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই অনুল্লেখিত কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল এবং ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঋণ এবং এই ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশলগত পদক্ষেপ।
মার্কিন জাতীয় ঋণের ভয়াবহ অবস্থা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ বর্তমানে ৩৬.৬০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি 14। ২০২৫ সালের ২রা জানুয়ারি, ঋণের সীমা ৩৬.১ ট্রিলিয়নে পুনঃস্থাপিত হয়েছিল 15। ২০২৪ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ১২৩%, যা ইঙ্গিত দেয় যে সরকার তার ঋণ পরিশোধে আরও বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে 14। ২০২৫ অর্থবছরে ঋণ রক্ষণাবেক্ষণে ৯২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে, যা মোট ফেডারেল ব্যয়ের ১৭% 14। কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস (CBO) অনুমান করেছে যে ঋণের সীমা বাড়ানো না হলে, ২০২৫ সালের আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকারের ঋণ গ্রহণের “অসাধারণ ব্যবস্থা” (extraordinary measures) ফুরিয়ে যাবে 15। এই বিশাল, ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় সরকারের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নীতি নির্ধারকদের জন্য প্রচলিত আর্থিক সমাধানের বাইরে “অপ্রচলিত” কৌশল অবলম্বনের চাপ সৃষ্টি করছে।
নিম্নোক্ত সারণিটি মার্কিন জাতীয় ঋণের প্রবণতা তুলে ধরে:
সারণি ২: মার্কিন জাতীয় ঋণের প্রবণতা (ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে) ও জিডিপি অনুপাত
অর্থবছর/বছর | মোট জাতীয় ঋণ (ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) | ঋণ-জিডিপি অনুপাত (%) |
২০২৩-২৪ | ৩৫.৪৬ 14 | ১২৩ 14 |
২০২৪-২৫ (বর্তমান) | ৩৬.৬০ 14 | (২০২৪ সালের অনুপাতের কাছাকাছি) |
এই সারণিটি মার্কিন জাতীয় ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং জিডিপি-র তুলনায় এর আকার স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি পাঠকের কাছে ঋণের ভয়াবহতা এবং এর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার চিত্র দেয়, যা ডলারের অবমূল্যায়ন কৌশলের পেছনের মূল চালিকাশক্তিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও আর্থিক দমন (Financial Repression) কৌশল
অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, দেশগুলো রপ্তানি বাড়াতে, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং সার্বভৌম ঋণের বোঝা কমাতে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে থাকে 17। যখন কোনো দেশের ঋণ অত্যধিক হয় এবং কর বৃদ্ধি বা ব্যয় কমানোর মাধ্যমে তা পরিশোধ করা কঠিন হয়, তখন সরকার প্রায়শই বেসরকারি খাত থেকে সরকারি খাতে তহবিল স্থানান্তরের নীতি গ্রহণ করে, যাকে “আর্থিক দমন” (Financial Repression) বলা হয় 18। আর্থিক দমনের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে: নামমাত্র সুদের হার কম রাখা (প্রায়শই মূল্যস্ফীতির হারের নিচে), যা সঞ্চয়ের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয় এবং সরকারের জন্য ঋণ নেওয়া সস্তা করে তোলে 18। নেতিবাচক প্রকৃত সুদের হার বিদ্যমান ঋণের প্রকৃত মূল্য হ্রাস করে এবং এটি এক প্রকার কর বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে 19।
ডলারের অবমূল্যায়ন বা আর্থিক দমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার বিশাল ঋণ ব্যবস্থাপনার একটি “পছন্দের পথ” হতে পারে। এটি সরাসরি কর বৃদ্ধি বা ব্যয় কমানোর মতো অপ্রিয় পদক্ষেপ এড়িয়ে ঋণদাতাদের (বিশেষত বিদেশী) উপর একটি “লুকানো কর” আরোপ করে 19। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ঋণ কমিয়েছিল তার উদাহরণ এই কৌশলের ঐতিহাসিক কার্যকারিতা প্রমাণ করে 19। এটি একটি সচেতন কৌশল, যা জনসাধারণের কাছে ততটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু এটি ঋণের ভার কমানোর একটি কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
ডলারের অবমূল্যায়নের প্রভাব ও ঝুঁকি
ডলারের অবমূল্যায়ন আমেরিকান পণ্যকে বিদেশী বাজারে সস্তা করে রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে 6। তবে, এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে: এটি আমদানির ব্যয় বাড়ায়, মূল্যস্ফীতি বাড়ায় এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে 6। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য, ডলার-ভিত্তিক ঋণের মূল্য কমে যায়, যা তাদের জন্য “স্পষ্ট এবং বেদনাদায়ক” হতে পারে এবং ডলার-ভিত্তিক সম্পদ থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে পারে 20। দীর্ঘমেয়াদে, এটি ডলারের বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে 6। ডলারের অবমূল্যায়ন একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এটি অভ্যন্তরীণভাবে ঋণ কমাতে সাহায্য করলেও, বৈশ্বিকভাবে এর রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন অর্থনীতির জন্য আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করবে এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
৫. ডলারের দুর্বলতার প্রভাব: বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য
মার্কিন ডলারের দুর্বলতা বাংলাদেশের টাকার স্থিতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
উদীয়মান অর্থনীতির জন্য দুর্বল ডলারের সুবিধা
যখন মার্কিন ডলার দুর্বল হয়, তখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর (যেমন বাংলাদেশ) মুদ্রার উপর অবমূল্যায়নের চাপ কমে আসে 8। এটি এই দেশগুলোর জন্য মূলধন প্রবাহকে উৎসাহিত করতে পারে, কারণ ডলার-ভিত্তিক সম্পদের তুলনায় তাদের স্থানীয় মুদ্রার সম্পদগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে 21। দুর্বল ডলারের কারণে ডলার-ভিত্তিক ঋণ পরিশোধের ব্যয় কমে যায়, যা বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বস্তিদায়ক 8। ডলারের দুর্বলতা বাংলাদেশের টাকার স্থিতিশীলতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে। এটি কেবল টাকার মানকে ধরে রাখতে সাহায্য করছে না, বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও সহায়ক হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক।
টাকার স্থিতিশীলতায় ডলারের দুর্বলতার অবদান
বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ সিস্টেমের মাধ্যমে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে 5, কিন্তু ডলারের বৈশ্বিক দুর্বলতা এই প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করে তুলছে। যদি ডলার শক্তিশালী থাকত, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে টাকার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা আরও কঠিন হতো, এমনকি শক্তিশালী রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ সত্ত্বেও। ডলারের দুর্বলতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাফল্যের একটি “সহায়ক বায়ু” হিসেবে কাজ করছে। এটি বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের জন্য একটি অনুকূল বৈশ্বিক পরিবেশ তৈরি করেছে, যা তাদের মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে।
আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির উপর সম্ভাব্য প্রভাব
ডলারের দুর্বলতা আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করতে পারে 6। তবে, টাকার স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে এই প্রভাব কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। যদিও দুর্বল ডলার টাকার স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক, তবে এটি আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও বহন করে 6। নীতি নির্ধারকদের এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এটি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
৬. উপসংহার: একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশি টাকার সাম্প্রতিক স্থিতিশীলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি একটি বহুমুখী ঘটনার ফল। এটি কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচক্ষণ মুদ্রানীতি, রেকর্ড রপ্তানি আয় এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহের মতো অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রতিফলন নয়, বরং মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক দুর্বলতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল জাতীয় ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশলগত সিদ্ধান্তের একটি পরোক্ষ পরিণতিও বটে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং এর মোকাবিলায় ডলারের অবমূল্যায়ন বা আর্থিক দমনের মতো “অপ্রচলিত” কৌশল অবলম্বনের প্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ “হিডেন” কারণ, যা টাকার বর্তমান স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। এই দিকটি প্রায়শই জাতীয় সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষিত থাকে, অথচ এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
যদিও ডলারের দুর্বলতা বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য একটি অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের চাপ এবং এর ফলে সৃষ্ট ডলারের গতিপথ বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, যার মধ্যে ডি-ডলারাইজেশন প্রচেষ্টার ত্বরণ অন্যতম। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের উচিত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক শক্তিকে আরও সুসংহত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রবণতাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায় এবং টাকার স্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদে বজায় থাকে। এটি একটি সমন্বিত এবং দূরদর্শী নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির দাবি রাখে, যা কেবল বর্তমানের সাফল্যকে ধরে রাখে না, বরং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোর জন্যও প্রস্তুত থাকে।
লেখক: সজীব সেন, প্রকৌশলী।
Works cited
- 2025-07-09-03-14-69210cd772691e690f5b887788ac1226.doc – Export Promotion Bureau, accessed July 14, 2025, https://epb.portal.gov.bd/sites/default/files/files/epb.portal.gov.bd/epb_export_data/60874f51_e5c6_4b35_813b_ab73246d2ac6/2025-07-09-03-14-69210cd772691e690f5b887788ac1226.doc
- Bangladesh’s export income totals over 48 bln USD in FY 2024-25 – China.org, accessed July 14, 2025, http://www.china.org.cn/world/Off_the_Wire/2025-07/03/content_117961160.shtml
- – YouTube, accessed July 14, 2025, https://m.youtube.com/post/UgkxGQIjbojnOS93m01eA_4_Fz7z021AlGgj
- Bangladesh receives record-high $3.29 billion in inward remittances in Mar 2025, accessed July 14, 2025, https://www.newsonair.gov.in/bangladesh-receives-record-high-3-29-billion-in-inward-remittances-in-mar-2025/
- Monetary Policy Statement – Bangladesh Bank, accessed July 14, 2025, https://www.bb.org.bd/monetaryactivity/mps/mps_h1fy25.pdf
- The Dollar Is Sinking: Here’s Why – Newsweek, accessed July 14, 2025, https://www.newsweek.com/why-us-dollar-sinking-2094774
- U.S. dollar weakens, off to worst start in more than half a century – YouTube, accessed July 14, 2025, https://www.youtube.com/watch?v=uXXmGKaaiPE
- Dollar weakens as global reserve currency, while de-dollarization efforts accelerate, accessed July 14, 2025, https://www.aa.com.tr/en/economy/dollar-weakens-as-global-reserve-currency-while-de-dollarization-efforts-accelerate/3628233
- U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY • OFFICE OF INTERNATIONAL AFFAIRS June 2025, accessed July 14, 2025, https://home.treasury.gov/system/files/136/June-2025-FX-Report.pdf
- Federal Reserve Calibrates Policy to Keep Inflation in Check | U.S. Bank, accessed July 14, 2025, https://www.usbank.com/investing/financial-perspectives/market-news/federal-reserve-tapering-asset-purchases.html
- What should we expect from the Fed in 2025? – BlackRock, accessed July 14, 2025, https://www.blackrock.com/us/financial-professionals/insights/fed-outlook-2025
- Global Economic Prospects – World Bank, accessed July 14, 2025, https://www.worldbank.org/en/publication/global-economic-prospects
- Geopolitical Risk Dashboard | BlackRock Investment Institute, accessed July 14, 2025, https://www.blackrock.com/corporate/insights/blackrock-investment-institute/interactive-charts/geopolitical-risk-dashboard
- Understanding the National Debt | U.S. Treasury Fiscal Data, accessed July 14, 2025, https://fiscaldata.treasury.gov/americas-finance-guide/national-debt/
- Federal Debt and the Statutory Limit, March 2025 – Congressional Budget Office, accessed July 14, 2025, https://www.cbo.gov/publication/61265
- Federal Debt and the Debt Limit in 2025 – Congress.gov, accessed July 14, 2025, https://www.congress.gov/crs-product/IN12045
- 3 Reasons Why Countries Devalue Their Currency – Investopedia, accessed July 14, 2025, https://www.investopedia.com/articles/investing/090215/3-reasons-why-countries-devalue-their-currency.asp
- What Is Financial Repression? – River, accessed July 14, 2025, https://river.com/learn/what-is-financial-repression/
- Financial repression – Wikipedia, accessed July 14, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Financial_repression
- What the Budget Bill Means for Our National Debt | TIME, accessed July 14, 2025, https://time.com/7299966/budget-bill-adds-to-national-debt/
- Emerging market currencies: the role of global risk, the US dollar and domestic forces – European Central Bank, accessed July 14, 2025, https://www.ecb.europa.eu/press/economic-bulletin/focus/2019/html/ecb.ebbox201903_02~29b4722819.en.html