দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে (৪ মার্চ) দেওয়া প্রথম ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালের কাবুল বিমানবন্দরের ‘অ্যাবি গেট’ বোমা হামলার সন্দেহভাজন মূল হোতাকে পাকিস্তানের সহায়তায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
মাত্র তিন মাস পর, হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানান। এটি মার্কিন প্রশাসনের এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ, কারণ আগে কখনও পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধান যিনি রাষ্ট্রপ্রধান নন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এইভাবে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এই সফর এমন এক সময়ে হলো, যখন ট্রাম্প সাত বছর আগেই পাকিস্তানকে ‘মিথ্যা ও প্রতারণার দেশ’ বলে সমালোচনা করেছিলেন এবং তার পূর্বসূরি জো বাইডেন পাকিস্তানকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
প্রেক্ষাপট: ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ও ইরান সংকট
ট্রাম্প ও মুনিরের এই বৈঠক ঘটে এমন এক সময়ে যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা তুঙ্গে। ইসরায়েলী সেনাবাহিনীর একাধিক হামলার জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
এছাড়া, পহেলগামে জঙ্গী হামলাকে কেন্দ্র মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্প দাবি করেন, এই যুদ্ধ থামাতে তিনিই মধ্যস্থতা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই দুই বুদ্ধিমান মানুষ মুনির ও মোদি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বিরত ছিলেন। আমি সম্মানিত বোধ করছি।’
তবে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি দাবি করেছেন, যুদ্ধবিরতি হয়েছিল শুধুই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো ‘মধ্যস্থতাকারী’ ছিল না।
পাকিস্তান কেন আবার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতায়?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কয়েকটি কৌশলগত কারণ ট্রাম্প প্রশাসনকে পাকিস্তানের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে: ‘অ্যাবি গেট’ বোমা হামলাকারীর গ্রেফতারে পাকিস্তানের সহায়তা।
ভারতের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে পাকিস্তানের দক্ষ প্রতিক্রিয়া। মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, দুর্লভ খনিজ (rare earth minerals) ও ক্রিপ্টো বিনিয়োগের প্রস্তাব।
মার্কিন সেন্টকম প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা বলেন, ‘তারা (পাকিস্তান) বর্তমানে সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং এতে অসাধারণ সহযোগিতা করছে।’
সেনাবাহিনীই কি পাকিস্তানের আসল শক্তি?
মুনিরের এই সফর এবং তার সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্যকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানে এখনো নীতিনির্ধারণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেনাবাহিনী, ঠিক যেমনটা ছিল আইয়ুব খান, জিয়া-উল-হক বা পারভেজ মোশারফের আমলে।
নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রাজারুমি বলেন, ‘এই বৈঠক মার্কিন-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ককে বৈধতা দিলেও, এটি অসামরিক সরকারের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য হুমকি।’
সমঝোতা, না সাময়িক সুবিধাভিত্তিক সম্পর্ক?
বিশ্লেষক মারভিন ওয়াইনবাউমের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন একটি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অস্থির নীতিতে’ চলে, ফলে এই সম্পর্ক অনেকটাই ‘ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যেতে পারে।’
আরেক বিশ্লেষক আরিফ আনসার মনে করেন, ‘এই বৈঠক সাময়িক কূটনৈতিক লাভ দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত, অনির্বাচিত আলোচনার সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অনাস্থা আরও বাড়াবে।’
সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি প্রায়ই ‘লেনদেন-ভিত্তিক’ ও ‘স্বার্থসংশ্লিষ্ট’ হয়ে থাকে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ হোক বা কাশ্মীর সংকট, প্রায় সব সময়ই সামরিক সহযোগিতা এবং স্বল্পমেয়াদী স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে।
এইবারের ‘রিসেট’ কি টেকসই কিছু হবে, নাকি অতীতের মতোই আরেকটি কৌশলগত পর্ব হিসেবে মিলিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরেফিরে আসছে।
সংকলন ও বিশ্লেষণ: রাফিউল সুমন
সূত্র: আল জাজিরা, হোয়াইট হাউস প্রেস ব্রিফিং, সেন্টকম, পলিট্যাক্ট।