গাজায় বিতর্কিত মানবিক সহায়তা কর্মসূচির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ভাড়াটে সংস্থা সেফ রিচ সলিউশন্স (এসআরএস) এখন বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে। এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে রয়েছেন শিকাগোর ধনকুবের বিনিয়োগকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা, যাদের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগীর সম্পর্ক রয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলি সমর্থিত এবং মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর বিতরণকেন্দ্রগুলোতে এসআরএস আরবি ভাষাভাষী ভাড়াটে নিরাপত্তা কর্মী পাঠিয়েছে। অথচ এই কেন্দ্রগুলোকে “মৃত্যু ফাঁদ” আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব স্থানে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে গিয়ে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এসআরএস প্রতিষ্ঠার গল্প মধ্যপ্রাচ্যে পুরনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও অর্থলোভী মার্কিন ব্যবসায়ীদের সম্পর্কের অন্ধকার জগতের একটি দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গাজার এই সহায়তা কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসআরএস-এর ভাড়াটে সেনারা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। যদিও এসআরএস দাবি করছে, তাদের স্থাপনায় “কোনো বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।”
গোয়েন্দা থেকে ব্যবসায়ী
এসআরএস পরিচালনা করছেন ফিল রেইলি, যিনি সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা। নিকারাগুয়ায় কনট্রা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে দায়িত্ব পালন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন কর্মসূচির সূচনালগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।
রেইলি এর আগে সারকিনাস নামের এক গোয়েন্দা সংস্থাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওই কোম্পানি ছিল ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ অর্থদাতা এলিয়ট ব্রোডির মালিকানাধীন। ব্রোডির প্রতিষ্ঠানটি ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার চুক্তি করে। ব্রোডি পরবর্তীতে অবৈধ লবিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হলেও ট্রাম্প তাকে ক্ষমা করেন।
পুঁজিবাজারের নজর গোয়েন্দা জগতে
এসআরএস-এর পেছনে রয়েছে শিকাগোভিত্তিক ম্যাকন্যালি ক্যাপিটাল নামের প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম। এর প্রতিষ্ঠাতা ওয়ার্ড ম্যাকন্যালি, যিনি মূলত ভৌগোলিক মানচিত্র প্রকাশনা ব্যবসা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল অর্থ পেয়েছিলেন এবং এখন সেই অর্থ বিনিয়োগ করছেন সামরিক ও গোয়েন্দা খাতে।
ম্যাকন্যালি এবং রেইলি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সুযোগে পরিণত করতে চেয়েছেন। গাজায় জাতিসংঘকে সরিয়ে দিয়ে বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে সাহায্য বিতরণ পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন, যা ইরাক যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের পুনরাবৃত্তি।
সরকারি অর্থায়নে বিতর্কিত কর্মসূচি
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জিএইচএফ কর্মসূচির জন্য ইতোমধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। জিএইচএফ-এর বার্ষিক বাজেট দাঁড়াতে পারে ১.৮ বিলিয়ন ডলারে। ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ৫৬,০০০ ছাড়িয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শুধু গত মাসেই, একদিনে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সহায়তা কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
বেসামরিক সহায়তা না সামরিক নিয়ন্ত্রণ?
সমালোচকরা বলছেন, গাজায় সাহায্য নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই এসব বেসরকারি সংস্থার মূল লক্ষ্য। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী-গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ফলে, গাজা আজ কেবল একটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও বেসরকারি যুদ্ধবাজদের অর্থলাভের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে।