গাজায় চলমান মানবিক সংকটের মধ্যে জাতিসংঘের তদারকি ছাড়াই পরিচালিত বিতর্কিত ত্রাণ প্রকল্পে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বস্টন কনসালটিং গ্রুপ (বিসিজি)। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পে পরামর্শ দেওয়ার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছে।
প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছিল গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কিছু মহল। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করেছে, কারণ এতে গাজার জনগণকে স্থানচ্যুত করার মতো পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
পুনর্বাসনের মোড়কে বাস্তুচ্যুতি?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিসিজি এই প্রকল্পের জন্য এমন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল, যেখানে গাজার বাসিন্দাদের ‘পুনর্বাসনের’ নামে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, এই পরিকল্পনা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির শামিল, যা আন্তর্জাতিক মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিসিজি কাজ করেছে ফগবাও নামের এক মার্কিন ভেটেরানদের পরিচালিত সংগঠনের সঙ্গে। এই সংগঠনটি মেরিটাইম হিউম্যানিটারিয়ান এইড ফাউন্ডেশন (এমএইচএএফ) নামের একটি সুইস-ভিত্তিক ত্রাণ সংস্থা গঠন করে, যার মাধ্যমে কাতারের অর্থায়নে সাইপ্রাস থেকে গাজায় খাদ্যপণ্য পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
প্রথমে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলেও পরে বিসিজি মার্চ ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের জন্য পারিশ্রমিক দাবি করে। তাদের কাজের মধ্যে ছিল এমএইচএএফ-এর আইনি কাঠামো গঠন, কাতারি কর্মকর্তাদের জন্য মাসিক প্রতিবেদন প্রস্তুত, এবং বিভিন্ন ঠিকাদার ও কর্মী নিয়োগে সহায়তা।
তবে ২০২৪ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজার উপকূলে ভাসমান সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের ঘোষণা দিলে থেমে যায় এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা। এতে করে সরাসরি খাদ্য সরবরাহের নতুন পথ চালু হওয়ায় এমএইচএএফ-এর প্রকল্পটি কার্যত বাতিল হয়ে যায়।
বিতর্ক ও পদত্যাগ
এই উদ্যোগ ঘিরে বিতর্ক চরমে পৌঁছালে বিসিজি’র দুই জ্যেষ্ঠ অংশীদার ম্যাট শ্লুটার ও রায়ান অর্ডওয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, এই দুইজন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত না নিয়েই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছিলেন এবং বিষয়টি জানার পর বিসিজি প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, বিসিজির অনেক কর্মী ও প্রাক্তন কর্মী প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা সমালোচনা করছেন। এতে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে বিসিজি’র সাবেক উপদেষ্টা এবং সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)-এর সাবেক কর্মকর্তা ফিল রেইলি-র নাম, যিনি বর্তমানে সেফ রিচ সল্যুশনস নামের একটি বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানির মাধ্যমে জিএইচএফ-এর বিভিন্ন কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত রয়েছেন।
গাজায় ‘ট্রাম্প রিভিয়েরা’ প্রকল্প?
এফটি’র আরেক প্রতিবেদনে জানা যায়, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার জন্য পরিকল্পনা তৈরির আলোচনায় অংশ নিয়েছিল টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট (টিবিআই)। সেই আলোচনায় গাজার উপকূলে একটি বিলাসবহুল ‘ট্রাম্প রিভিয়েরা’ রিসোর্ট নির্মাণের প্রস্তাবসহ বিসিজি-প্রণীত আর্থিক মডেল উপস্থাপন করা হয়েছিল।
তবে টিবিআই জানিয়েছে, তাদের প্রতিনিধিরা শুধুমাত্র “শ্রোতার ভূমিকায়” বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং প্রস্তাবনার সাথে তাদের কোনো প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস