সময়ের জনমাধ্যম

কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি: স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী, অনিশ্চয়তা দীর্ঘস্থায়ী

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও, কাশ্মীর উপত্যকার পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। যুদ্ধ থামলেও, এখানকার বাসিন্দাদের মনে এখনও চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। দীর্ঘদিনের সংঘাতের পর সাময়িক স্বস্তি মিললেও, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এখানকার বাসিন্দা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত শনিবার (১০ মে) সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অনেকের মনে শান্তির আশা জাগালেও, এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। কাশ্মীরের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাফর চৌধুরী মনে করেন, ‘কাশ্মীর ইস্যু বরাবরই ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। ট্রাম্পের প্রস্তাব এটি আবারও প্রমাণ করে। কিন্তু ভারতের জন্য এটি অস্বস্তিকর, কারণ তারা বরাবরই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেছে।’

সীমান্তের মানুষের জীবন যেন এক দীর্ঘ ছায়াযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি। সাম্প্রতিক সংঘাতে উরি, পুঞ্চ এবং রাজৌরি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। উরির বাসিন্দা সুলেমান শেখের কথায়, ‘আমাদের এলাকায় রাতভর গোলাগুলি চলে। ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’ ২০১৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

কাশ্মীর সমস্যার গভীরে প্রোথিত রাজনৈতিক অচলাবস্থা। সাবেক অধ্যাপক নূর আহমদ বাবা মনে করেন, ‘কাশ্মীরের মানুষ রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও বঞ্চনার শিকার। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কখনো গুরুত্ব পায়নি।’ ভারত কাশ্মীরকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখায়, অন্যদিকে পাকিস্তান এটিকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে। এই বিপরীতমুখী অবস্থানে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান অধরাই থেকে গেছে।

সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ। শ্রীনগরের ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্র হাসনাইন শাবিরের অভিজ্ঞতা, ‘আমি কখনো এত ভয় পাইনি। যুদ্ধের প্রাক্কালে যদি এমন হয়, আসল যুদ্ধ কেমন হবে?’ গোলাগুলির কারণে সীমান্ত এলাকায় স্কুল-কলেজ বন্ধ, বাজার জনশূন্য, আর মানুষের মনে কেবলই ভয়। পর্যটন ও কৃষিনির্ভর কাশ্মীরের অর্থনীতি এই সংঘাতের কারণে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হলেও, কাশ্মীরের মানুষ এটিকে স্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখছেন না। অনেকের বিশ্বাস, বহিরাগত হস্তক্ষেপ এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী নিরাময় আনতে পারবে না। শ্রীনগরের বাসিন্দা মুনীব মেহরাজের স্পষ্ট চাওয়া, ‘আমরা সাময়িক শান্তি চাই না, আমরা স্থায়ী সমাধান চাই।’

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তরিক আলোচনা ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। তবে উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান গভীর অবিশ্বাস সেই আলোচনাকে কঠিন করে তুলেছে। কাশ্মীরের মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ‘কতদিন এভাবে চলবে?’

ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ‘ভারত সম্ভবত এই যুদ্ধবিরতির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর আলোচনায় আগ্রহী নয়। এটি বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে।’ তিনি মনে করেন, এই যুদ্ধবিরতি ছিল “হঠাৎ করেই সমঝোতার ফল,” যা তীব্র উত্তেজনার মধ্যে তড়িঘড়ি কার্যকর হয়। তবে, ট্রাম্পের বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

ভারত কাশ্মীরকে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে গণ্য করে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। বিপরীতে, পাকিস্তান বারবার এটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করে। যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির মন্তব্য, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয়তা ছাড়া পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতো না।’

ভারতে যুদ্ধবিরতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী কংগ্রেস দলের প্রশ্ন, ‘আমরা কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় সম্মতি দিয়েছি?’

পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মোইদ ইউসুফের স্পষ্ট বার্তা, ‘মূল সমস্যা সমাধান না হলে প্রতিবারের মতো আবারও সংঘাত দেখা দেবে।’ তাই, যুদ্ধবিরতি কাশ্মীরের মানুষের জন্য কেবল ক্ষণিকের স্বস্তি, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির আশা ক্ষীণ।