মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) কাশ্মীরের মনোরম পর্যটন কেন্দ্র পহেলগামে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হামলায় অন্তত ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন। গত ২৫ বছরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার এই পর্যটন কেন্দ্রে হামলায় ভারতজুড়ে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটল যখন শত শত পর্যটক এই অঞ্চলে ছুটি কাটাচ্ছেন, যেখানে তিন দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে।

হামলার পরপরই পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং আহত পর্যটকদের উদ্ধার করে। হামলাকারীদের ধরতে অভিযানও শুরু করে তারা।
ঘটনার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দ্রুত কাশ্মীর যান, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরবের সফর সংক্ষিপ্ত করে নয়াদিল্লি ফিরে আসেন। এরপর বুধবার সকালে ভারতের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে বৈঠক করেন তারা।
এই হামলার ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন ভারত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের আতিথেয়তা করছে। গত সোমবার (২১ এপ্রিল) ভারত সফরে আসেন তিনি। আগামী বৃহস্পতিবার ফিরে যাবেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
যাকিছু ঘটেছে:
কাশ্মীরি ভাষায় “ভেড়াওয়ালাদের উপত্যকা” অর্থ পহেলগাম, শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
মঙ্গলবার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এলাকাটি পর্যটকদের ভিড়ে পূর্ণ ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে ছদ্মবেশে সশস্ত্র একদল লোক নিকটবর্তী বন থেকে বেরিয়ে আসে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারীরা “বাইসারান তৃণভূমিতে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়, যা একটি মনোরম উঁচু এলাকা এবং পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়।” আকস্মিক গুলির শব্দে বহু পর্যটক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।

পশ্চিম ভারতীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আসা পর্যটক সিমরান চান্দানি বলেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যে তিনি বেঁচে ফিরতে পারবেন কিনা।
তিনি বলেন, “চা ও ম্যাগি নুডুলস খাওয়ার পর আমরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনই হামলা শুরু হয়।” পহেলগামকে “ছোট সুইজারল্যান্ড” আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “আমি দেখলাম বহু লোক নিচে নেমে আসছে, আমরা ভেবেছিলাম বেলুন ফেটেছে, লোকেরা একে অপরের ওপর ধাক্কা দিচ্ছিল, তখন একজন বলল হামলা হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, বেশিরভাগ পুরুষদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। চান্দানি বলেন, “আমি ঈশ্বরের নাম জপ করছিলাম এবং দৌড়াচ্ছিলাম।”
কতজন নিহত হয়েছেন এবং তাদের পরিচয়:
এই হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন। নিহত পর্যটকদের প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক এবং তাদের মধ্যে উত্তর ভারতীয় রাজ্য হরিয়ানার একজন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় কাশ্মীর গিয়েছিলেন।
নিহতদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশের পান্ডুরাঙ্গাপুরমের ৬৮ বছর বয়সী এক প্রাক্তন ব্যাংকারও ছিলেন, যিনি স্ত্রীর সাথে ওই অঞ্চলে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এছাড়াও নিহতদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকের একজন রিয়েলটর, পূর্ব ভারতীয় রাজ্য ওডিশার একজন হিসাবরক্ষক, উত্তর প্রদেশের একজন সিমেন্ট ব্যবসায়ী এবং দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কেরালার একজন ব্যবসায়ী। নিহতদের মধ্যে নেপাল থেকে আগত বিদেশি নাগরিকও ছিলেন।

কে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে:
দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামক একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। মনে করা হয়, এই সংগঠনটি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা।
বিবৃতিতে এই হামলার কারণ হিসেবে কাশ্মীরিদের বাইরে ভারতীয় নাগরিকদের হাজার হাজার রেসিডেন্সি পারমিট দেওয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, বিবৃতির সত্যতা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ভারতের সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। এই পদক্ষেপের ফলে অঞ্চলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে এবং ভারত সরকার অ-কাশ্মীরিদের বসবাসের অনুমতি দেওয়ার পথ প্রশস্ত হয়, যা আগে নিষিদ্ধ ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, তারা সন্দেহ করছেন চারজন হামলাকারী এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের এবং দুজন ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বাসিন্দা।