সময়ের জনমাধ্যম

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে পরমাণু বিস্তার ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন শঙ্কা

ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রতিক সশস্ত্র সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক ভারসাম্য, আন্তর্জাতিক আইন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে নতুন করে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

ইসরায়েল যেভাবে ইরানে হামলা চালিয়েছে, তা তার অতীতের আঞ্চলিক হস্তক্ষেপের চেনা ছকেই করা হয়েছে, কেবল সামরিক স্থাপনা নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো বেসামরিক অবকাঠামোও ছিল তাদের নিশানায়। এসব হামলায় শত শত ইরানি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা কাকতালীয় নয়। বরং ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরাগমনের পর যে সংলাপের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাহত করতেই এই সামরিক অভিযানের আয়োজন।

ওয়াশিংটনের দ্বিচারিতা

ট্রাম্প প্রশাসনের সরাসরি জড়িয়ে পড়া তার পূর্বঘোষিত ‘বিদেশে ব্যয়বহুল যুদ্ধ বন্ধ’-নীতি লঙ্ঘন করে। একইসঙ্গে এটি দেখিয়ে দেয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ইসরায়েলের প্রভাব কতটা প্রবল।

ইসরায়েল বিমান ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করলেও, ইরান সামরিক জবাব দিতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা ছাড়াও, ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে কৌশলগত হামলা চালিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

প্রাথমিকভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিজয়োচ্ছ্বাস দেখা গেলেও, এখন সেই আত্মবিশ্বাস ম্লান হয়ে গেছে। কারণ এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে, এই হামলায় কতটা সফলতা এসেছে এবং ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত কোথায় রয়েছে, তা নিয়ে।

পরবর্তী পদক্ষেপ অনিশ্চিত

যুদ্ধবিরতি আপাতত কার্যকর থাকলেও, তা অত্যন্ত নড়বড়ে। তেহরান বারবার সতর্ক করে এসেছে, মার্কিন হামলা হলে জবাব আসবেই। কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে সীমিত পাল্টা আঘাত সেই বার্তারই এক নিয়ন্ত্রিত রূপ।

তেহরানের কৌশলগত পছন্দের মধ্যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা অথবা ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনায় পাল্টা হামলার বিষয়টি আলোচিত হলেও, তার আগেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে।

ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র এবং তার কোনো স্থাপনা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় নেই। ফলে এই অঞ্চলে অস্থিরতা আরও গভীর হচ্ছে।

পরমাণু বিস্তার ও বৈশ্বিক ঝুঁকি

ইরানকে  ‘আত্মসমর্পণে’ বাধ্য করার ধারণা ছিল একেবারেই অবাস্তব। যদি যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হয়, তবে সামনের দিনগুলোতে এক দীর্ঘস্থায়ী, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর ও কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকেই যায়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ের জন্যই কঠিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

এর চেয়েও বড় উদ্বেগ হল, অ-পারমাণবিক রাষ্ট্রের ওপর হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক রাষ্ট্র এখন এটিকে একটি বার্তা হিসেবে নিচ্ছে- নিরস্ত্রীকরণের চেয়ে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনই নিরাপত্তার একমাত্র পথ।

ইরান যে পরিমাণ পারমাণবিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি অর্জন করেছে, তা বোমা মেরে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ইসরায়েলের তথাকথিত ‘স্কলারসাইড’ বা জ্ঞানের কেন্দ্রগুলোর ওপর হামলা কেবল ইরানিদের ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মনোভাবকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ট্রাম্পের দ্বিধাগ্রস্ত নেতৃত্ব

ট্রাম্পের নীতিগত দ্বন্দ্ব পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। একদিকে শান্তি আলোচনার ইঙ্গিত, পরক্ষণেই পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা, আবার কিছুদিন পর কূটনৈতিক বার্তা, এই পরস্পরবিরোধী  অবস্থান তেহরানের জন্য নির্দিষ্ট কৌশল নির্ধারণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা শাসন পরিবর্তনের বিষয়ে যে দ্বিধাপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, তা ইরানিদের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

বিদেশি হস্তক্ষেপ দিয়ে ইরানে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা যাবে, এই ধারণা অতীতেও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভিতরে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও, বিদেশি সামরিক হামলা কখনোই গণবিপ্লব সৃষ্টি করেনি, বরং উল্টো জাতীয় ঐক্য জোরদার হয়েছে।

ইউরোপের নীরবতা ও নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার বিপর্যয়

এই সংকটে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কণ্ঠস্বর ছিল নরম, নিষ্ক্রিয় ও অনেকাংশে ‘কপি-পেস্ট’ ধরনের। তথাকথিত ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’র রক্ষক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও, বাস্তবে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নিরাপত্তা যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ইউক্রেন ও গাজা ইস্যুতে দ্বিচারিতা ও দ্বিমুখী নীতির জন্য এমনিতেই ইউরোপের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একতরফা আগ্রাসনকে মেনে নেওয়া সেই অবিশ্বাসকে আরও গাঢ় করেছে।

‘শক্তির ন্যায্যতা’কে ভিত্তি করে যদি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তবে সেটি দীর্ঘমেয়াদে কারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের এই কার্যক্রম কেবল ইরান নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক আগ্রাসন ও কূটনৈতিক দ্বিচারিতার এই যুগে, পারমাণবিক বিস্তার ঠেকানোর আশায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।