সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা চরমভাবে এর শিকার হচ্ছেন। একদিকে সেন্সরশিপ, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে সহিংসতা—দুই দিক থেকেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে।
সেন্সরশিপের নতুন দৌরাত্ম্য
ইসরায়েলের ঘৃণ্য সেন্সরশিপ ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। তবে ২০২৪ সাল থেকে এটি নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ১,৬৩৫টি প্রতিবেদন প্রকাশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা এবং ৬,২৬৫টি প্রতিবেদন আংশিকভাবে সেন্সর করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে ২১টি সংবাদ প্রতিবেদন সেন্সরশিপের মুখে পড়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এ নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।
গত মাসে নতুন কিছু নির্দেশনা জারি হয়েছে, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থান থেকে রিপোর্ট করতে সেনাবাহিনীর লিখিত অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া সংবাদ প্রকাশ করলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী ‘ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস’ এটিকে ইসরায়েলের গণমাধ্যম স্বাধীনতার “শেষ পেরেক” বলে আখ্যা দিয়েছে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর দ্বিগুণ দমন
সাংবাদিক দমন-পীড়নের সবচেয়ে বড় শিকার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা। গালিল অঞ্চলের ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রাজি তাতুর একাধিকবার পুলিশের হেনস্তা ও আক্রমণের শিকার হন। কখনো লাইভ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কখনো ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালি দেয়া হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার জন্য কাজ করা সত্ত্বেও তার ক্যামেরা ও সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।
তাতুরের অভিজ্ঞতাগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি বৃহত্তর নীতির অংশ। ইসরায়েলি সরকার সাংবাদিকদের, বিশেষ করে আরব এবং ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ভীত-সন্ত্রস্ত রাখতে চায়, যাতে তারা সেন্সরশিপ অমান্য করার সাহস না দেখায়।
জাতিগত পরিচয়ের ওপর নির্ভর করছে সাংবাদিকতার অধিকার
‘ইলাম মিডিয়া সেন্টার’-এর প্রধান আন্তন শালহাত বলছেন, সাংবাদিকতার অধিকার এখন আর সাংবিধানিক অধিকার নয়; বরং তা নির্ধারিত হচ্ছে জাতিগত পরিচয় ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। আরব সাংবাদিকরা ইসরায়েলে “অভ্যন্তরীণ শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন।
এমনকি, সাধারণ জনগণ এবং পুলিশও আরব সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এটি এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে আইনের লঙ্ঘনকেও প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে, যদি টার্গেট ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হন।
আরও বিস্তৃত দমননীতি
শুধু ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা নয়, ইসরায়েলি বামপন্থী সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদকর্মীরাও এ দমননীতির শিকার হচ্ছেন। ‘লোকাল কল’ নামের হিব্রু নিউজ সাইটের ওরেন জিভের মতে, জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির এবং যোগাযোগ মন্ত্রী শ্লোমো কারহি সাংবাদিকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণকে বৈধতা দিয়েছেন।
ফলস্বরূপ, অনেক সাংবাদিক এখন স্বেচ্ছায় সেন্সরশিপ মানছেন, আতঙ্কের কারণে অনেক ছবি বা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না। পুলিশের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় তাদের ছবি তুলতে দেয়া হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১০১ থেকে ১১২তম স্থানে অবনমন হয়েছে দখলদার দেশটির। গাজা যুদ্ধকে তারা সাংবাদিকদের জন্য ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিন্দা সত্ত্বেও ইসরায়েলি সরকার এখনো তার নীতিতে স্থির। বরং, আল জাজিরা নিষিদ্ধের পর এখন অভ্যন্তরীণ আরব সাংবাদিকদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।
গণতান্ত্রিক পরিচয়ের দাবিদার ইসরায়েল সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষার বদলে আজ তা দমনে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তার অজুহাতে সেন্সরশিপ, জাতিগত বৈষম্য এবং সহিংসতা, সব মিলিয়ে ইসরায়েল গণমাধ্যমের জন্য নিয়ন্ত্রিত এবং ভীতিকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, কতটা নির্লজ্জ্ব হলে ইসরায়েল নিজেদের মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করতে পারে?