সময়ের জনমাধ্যম

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত কোনদিকে

গত শুক্রবার (১৩ জুন) ইরানে নজিরবিহীন বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দখলদার দেশটির সেনাবাহিনী এর নামকরণ করেছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এই হামলায় ২০০-রও বেশি ফাইটার জেট ব্যবহার করে ইরানের ১০০টিরও বেশি পরমাণু, সামরিক স্থাপনায় ধ্বংসজ্ঞ চালানো হয়।

হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা।

ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা নাতাঞ্জের ভূগর্ভস্থ মাল্টিস্টোরি সেন্ট্রিফিউজ হল, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো ধ্বংস করেছে, যা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল চালিকাশক্তি।

হামলায় কারা নিহত হয়েছেন?

এই হামলায় ৬ জন শীর্ষপরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দু’জনকে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচির “মূল স্তম্ভ” হিসেবে গণ্য করে আসছে।

ড. মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচি

  • ইরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট
  • তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও পরমাণু কর্মসূচিতে সরাসরি যুক্ত
  • ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ উল্লেখ করে কালো তালিকাভুক্ত করে

ফেরেদুন আব্বাসি

  • ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান
  • প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পরমাণু গবেষণায় অভিজ্ঞ
  • ২০১০ সালে হত্যা প্রচেষ্টায় আহত হয়েছিলেন

নিহত অন্যান্য বিজ্ঞানীরা:

  • আবদুলহামিদ মিনুচেহর: পরমাণু প্রকৌশলে পিএইচডি, শাহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ডিন
  • আহমদ রেজা জোলফাঘারি: পরমাণু প্রকৌশলের অধ্যাপক
  • আমির হোসেইন ফাগিহি: ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক উপপ্রধান ও নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক
  • মোতাল্লেবজাদে: একজন স্বল্প পরিচিত বিজ্ঞানী, যিনি স্ত্রীসহ নিহত হয়েছেন

কোন পরমাণু স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু ছিল?

  • নাতাঞ্জ ছিল প্রধান টার্গেট, এটি ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
  • আন্তর্জাতিক পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা (আইএইএ ) জানিয়েছে, হামলার পরও রেডিয়েশন বৃদ্ধি পায়নি
  • বুশেহর, ইসফাহান, ফোরদোর সহ অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনায় এখনও হামলা চালানো হয়নি

ইরান কী বলছে?

  • ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন: ‘ইসরায়েলকে এর চরম মূল্য দিতে হবে’
  • ইরান জানিয়েছে, নিহত হয়েছেন আরও তিন জন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মোহাম্মদ বাঘেরি, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ র‍্যাংকের একজন সামরিক কর্মকর্তা

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান:

হামলার আগের দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা ইরানের সাথে ভাল একটি চুক্তির কাছাকাছি… তবে সামরিক পদক্ষেপ সবকিছু নষ্ট করতে পারে।’

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে তাদের দূতাবাস আংশিক সরিয়ে নেয়, এবং মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতিকদের পরিবার সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয় যা হামলার পূর্বাভাস দিয়েছিল।

আগেও কি ইসরায়েল পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে?

হ্যাঁ। ইসরায়েল একাধিকবার ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে, যদিও এর আগে তারা কখনো সরাসরি দায় স্বীকার করেনি।

২০২০: মোহসেন ফাখরিজাদে, রিমোট কন্ট্রোল বন্দুক দিয়ে হত্যা
২০১২: মোস্তফা আহমাদি রোশান, গাড়িতে চুম্বক বোমা
২০১০: মাজিদ শাহরিয়ারি, গাড়ি বোমায় নিহত, একই হামলায় ফেরেইদুন আব্বাসি আহত হন
২০১০: মাসউদ আলি মোহাম্মাদি, দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে নিহত

এই হামলা কতটা ভিন্ন?

এবারের হামলা শুধু সাইবার বা গুপ্তচরবৃত্তি নয়, সরাসরি বিমান হামলায় ইরানের ভেতরে প্রবেশ করেছে ইসরায়েল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু অস্ত্রের ব্যাপার নয়, বরং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতারও প্রমাণ, তারা জানে কে কোথায় আছে।

সামনে কী হতে পারে?

  • ইরান প্রতিশোধ নেবে, এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট
  • ইসরায়েল বলেছে, ‘হুমকি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন চলবে’
  • বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাপ্রবাহ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে তুলবে।