সময়ের জনমাধ্যম

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা: পারমাণবিক দূষণের আশঙ্কা!

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যে হামলা চালানো হয়েছে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই, বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা জাগিয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলছে, এই হামলার ফলে রেডিওলজিক্যাল ও কেমিক্যাল দূষণের আশংকা তৈরি হয়েছে।

কোথায় এবং কী ধরনের হামলা হয়েছে?
গত শুক্রবার, ইসরায়েল একযোগে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র এবং ইসফাহানের আরেকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। নাতাঞ্জ বহু বছর ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বহুদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য সামরিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তবে এবারের হামলার সময়কালও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি ঘটেছে তখন যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা চলছিল।

পারমাণবিক দূষণের ঝুঁকি কতটা?

সোমবার (১৭ জুন) ভিয়েনায় আইএইএ-এর জরুরি বোর্ড সভায় সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি জানান, ‘বর্তমানে নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান স্থাপনাগুলোর বাইরের বিকিরণ মাত্রা স্বাভাবিক আছে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘সামরিক উত্তেজনা পারমাণবিক বিকিরণ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।’

গ্রোসি জানান, হামলায় নাতাঞ্জ স্থাপনাটির ভূউপরিস্থ কাঠামো ধ্বংস হয়েছে। যদিও ভূগর্ভস্থ মূল সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনাটি সরাসরি আক্রান্ত হয়নি, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানে থাকা স্পিনিং সেন্ট্রিফিউজগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।এই সেন্ট্রিফিউজগুলোতে ব্যবহৃত গ্যাস ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি ত্বক পুড়িয়ে দিতে পারে এবং শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে গেলে প্রাণঘাতী হতে পারে।

গ্রোসি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে এই গ্যাস থেকে রাসায়নিক দূষণের আশঙ্কা।’ তবে এই গ্যাস বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান কায়া ক্যালাস বলেছেন, ‘আমরা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার বিপক্ষে। তবে এই সমস্যা সমাধানে আমাদের পথ হলো কূটনীতি, সামরিক পদক্ষেপ নয়।’

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। তবে আমরা কখনোই ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেব না।’

ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

অতীতে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নজির আছে?
সচল পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলার ঘটনা এটিই প্রথম। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নির্মাণাধীন বা গবেষণা-নির্ভর পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আগেও হামলার শিকার হয়েছে।
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরান ইরাকের ওসিরাক চুল্লিতে আঘাত হানে। পরের বছর ইসরায়েল সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয় (অপারেশন অপেরা)।

২০০৭ সালে ইসরায়েল সিরিয়ায় উত্তর কোরিয়ার সহায়তায়-নির্মিত চুল্লি ধ্বংস করে (অপারেশন আউটসাইড দ্য বক্স)। স্পেন, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক স্থাপনায়ও অতীতে রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে?

বিশ্ব বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট–এর পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়ে আমরা অনেক বেশি বিপদের মধ্যে থাকি ভুল সিদ্ধান্ত বা প্রযুক্তিগত বিভ্রান্তির কারণে।’ তিনি ১৯৮৩ সালের স্তানিস্লাভ পেত্রোভ ঘটনার উল্লেখ করেন, যেখানে সোভিয়েত কর্মকর্তা ভুলভাবে মার্কিন পারমাণবিক হামলার সিগন্যাল পেয়েছিলেন, কিন্তু তা রিপোর্ট না করে বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকান।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পারমাণবিক নিরাপত্তা

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার শুরুতেই দখল করা হয় জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক প্ল্যান্ট। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন তখন বলেছিলেন, ‘রাশিয়া প্ল্যান্টটিকে মিলিটারি বেস হিসেবে ব্যবহার করছে, কারণ ইউক্রেন সরাসরি সেখানে আঘাত করতে পারবে না।’

আইএইএ পরে সেখানে হস্তক্ষেপ করে রিঅ্যাক্টরগুলো বন্ধ করায় বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়। তবে এখনো প্ল্যান্টটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি।

ইসরায়েল পরিচালিত এই ঘৃণ্য ধ্বংসযজ্ঞ পরমাণবিক স্থাপনায় সামরিক হামলার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরিবর্তে যদি এমন পদক্ষেপই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হয়, তাহলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, গোটা বিশ্বে পারমাণবিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। গ্রোসি শেষ পর্যন্ত সতর্ক করে বলেছেন, ‘এই অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন তাৎক্ষণিক তথ্য এবং পূর্ণ সহযোগিতা, তা না হলে ভবিষ্যতের বিপদ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।’