সময়ের জনমাধ্যম

আম উৎপাদন ও বিশ্ববাজারে রপ্তানির জন্য সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন

দেশে আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশি আমের বাজার তৈরি করতে হবে। এজন্য অঞ্চলভিত্তিক প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠা করাসহ আটটি দাবি জানিয়েছেন আম চাষী, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা। এছাড়াও গণমাধ্যমে আমে রাসায়নিক মেশানোর কথিত প্রোপাগান্ডা বন্ধেরও দাবি তাদের।

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢাকা- সিজেএফডি’র আয়োজনে ‘বাংলাদেশে আম উৎপাদন: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় আম সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন।

সিজেএফডি’র সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি, ঢাকা’র সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ এগ্রো-কেমিক্যাল ম্যানুফাকচারাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এস এম মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. গোলাম রাব্বানী। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন সিজেএফডি’র সাধারণ সম্পাদক
জিয়াউল হক সবুজ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিজেএফডি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার হক। সেমিনারে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, আমচাষীসহ কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতেই আমের চাষ বেশি হয়। জীবন জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন আম চাষ হচ্ছে। বর্তমানে নওগাঁ জেলায় আমের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। আমি আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ২০০৯ সালে একটি সমিতি করি। ২০২১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে সিলেট ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন গাড়িতে আম যেত, তখন ফরমালিনের কথা বলে সকল আম নষ্ট করে দেয়া হতো। এ থেকেই বাংলাদেশের মানুষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী আমের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।

শাহরিয়ার আলম আরও বলেন, আসল ঘটনা না বুঝে গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিতভাবে খবরগুলো প্রচার হওয়ার কারণেই রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ও আমচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আসলে আমচাষীরা ফরমালিন মেশান না। এগুকো করে মূলত মধ্যস্বত্বভোগীরা। বিষয়টি নিয়ে সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথেও কথা বলেন শাহরিয়ার আলম।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে ফলের জন্য একমাত্র কোয়ারেন্টিন সেন্টার শ্যামপুরে কিন্তু সেটিও বন্ধ রয়েছে। কৃষিমন্ত্রীকে আহ্বান জানানোর পর দেশের চারটি স্থানে কোয়ারেন্টিন সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি, এগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।

শাহরিয়ার আলম জানান, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের আম রপ্তানি হয়েছে, শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কারণে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে কারণ বাংলাদেশের আমই সবচেয়ে সুস্বাদু। এক্ষেত্রে আমাদের গ্যাপের নিয়ম অনুসারে আম চাষ করতে হবে তবেই আম বিদেশের যে কোনো রাষ্ট্রে রপ্তানি করা যাবে।

অনুষ্ঠানে মু. জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের আম চাষের সমস্যা অনেক, এই সমস্যার সমাধান সমাধান করতে হবে। আম সারাদেশেই হয়, তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সুস্বাদু হয়ে থাকে। তাই আম চাষের জন্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

ঢাকার রেঞ্জ ডিআইজি নুরুল ইসলাম বলেন, আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ। জন্মের পর থেকে আমগাছ দেখেছি। আমাদের এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার প্রধানতম উৎস হচ্ছে আম চাষ। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে ভালো মানের আম পৌঁছে দিতে পারিনি। আম চাষ লাভজনক না হলে এক সময় আম আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে আম চাষ কীভাবে আরও লাভ লাভজনক করা যায়। আমরা বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী আম পৌঁছে দিতে পারছিনা। এ ব্যাপারে আমাদের আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। প্যাকিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে।

আম চাষের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় তুলে ধরেন বক্তারা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার সীমিত রেখে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে আম উৎপাদন করা, আমের প্যাকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, আম পরিবহনের জন্য আধুনিক যানবাহনের ব্যবস্থা করা, বিমানের কার্গোতে আম পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজতর করা, রপ্তানী উপযোগী আমের চাষ সম্প্রসারণ করা, আম চাষী বিশেষ করে রপ্তানীর জন্য আম উৎপাদনকারীগণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, আম থেকে উৎপাদিত পণ্য যেমন জুস, জ্যাম, জেলি, আচার, ক্যান্ডি ইত্যাদির বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করা, আমভিত্তিক শিল্প স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা, জৈব প্রযুক্তিনির্ভর আম উৎপাদন উৎসাহিত করা, আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, আম রপ্তানীর বিষয়ে সকল রপ্তানীকারকের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং মানদণ্ড ঠিক করে দেয়া।

আম শিল্পে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে ড. মুখলেসুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ অন্যতম আম উৎপাদক দেশ। এদেশের আবহাওয়া ও মাটি আম চাষের জন্য অনুকুল। আম উৎপাদনের মৌসুম মে- সেপ্টেম্বর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আম চাষের পরিধি ও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমের জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গোপালভোগ, খিরসাপাত, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলী, আশ্বিনা বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-১১, বারি আম-১২ ইত্যাদি। পুরোনো বয়স্ক বাগানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। সেগুলোতে হাইব্রিড জাতের বাগান তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ২৫ লক্ষ মেট্রিকটন আম উৎপন্ন হয়। এরমধ্যে সঠিকভাবে সংগ্রহ না করার কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০-৪০%। জুন জুলাই মাসে পিক মৌসুমে উৎপাদন প্রাচুর্যের কারণে আমের মূল্য হ্রাস পায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, তার বক্তব্যে আম চাষ ও বিপণনের ক্ষেত্রে বেশকিছু গবেষণালদ্ধ সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর মাধ্যমে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ (GAP) অনুসরণপূর্বক রপ্তানিযোগ্য নিরাপদ আম উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আম উপাদন ও উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমদানিকারক দেশ কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন শর্তাবলী পূরণ না করা, রপ্তানিযোগ্য উন্নতমানের আম উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে ভ্যালুচেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী, কোয়ারেন্টিন বিভাগ ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাব, গাছ থেকে আম সংগ্রহের উপযুক্ত পরিপক্কতা পর্যায় নির্ধারন ও সংগ্রহোত্তর উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত জ্ঞান, দক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জন্য দেশের প্রধান প্রধান উৎপাদন এলাকায় অদ্যাবধি মানসম্মত হিমাগার ও প্যাকিং হাউজ গড়ে না উঠা, সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে গ্রেডিং, প্যাকিং করে কুলিং ভ্যানের মাধ্যমে পরিবহণ না করা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি করতে না পারা এবং উন্নতমানের নিরাপদ আম রপ্তানির জন্য রপ্তানিকারকদের অনীহা ও মানসিকতা তৈরি না হওয়া, আমে উপস্থিত পেস্টিসাইডের রেসিডিও অ্যানালাইসিস ও ফলের গুণমান পরীক্ষার জন্য পূর্ণ সক্ষমতা সম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরির অভাব, আমের উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষ করে কোয়ারেন্টিন পেস্ট যেমন, ফ্রুট ফ্লাই, অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পচা রোগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব, উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে ফসলে ব্যবহৃত যাবতীয় উপকরণ ও কার্যক্রম ফার্ম রেকর্ড বইয়ে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ না করা ইত্যাদি।